চলছে বিড়ালদের বিদ্রোহ। দীর্ঘদিন ধরে অভুক্ত থাকার মতো ধৈর্য তাদের কুলায় না। মাছের কাঁটা, গরুর হাড্ডি কিছুই তো পাচ্ছে না অনেক দিন। রাজ্যে যে বসন্তের বাতাস বইছে। কিন্তু এত বসন্তের ফুল দেখে কী লাভটা হবে বলেন তো? যদি না পায় তারা মাছের কাঁটা কিংবা হাড্ডি।
পথে, মাঠে, ঘাটে বেরিয়ে পড়েছে, স্লোগান তুলছে ‘হাড্ডি চাই, কাঁটা চাই, হাড্ডি চাই, কাঁটা চাই’। বিড়াল রাজা পড়লেন মহা মুশকিলে!
ললিত বনের চন্দন গাছটায় টিয়া পরিবারটার বাসস্থান। কত ঝড় এল-গেল, তাদের সরাতে পারেনি। তিন প্রজন্মের বাস তাদের একই বাসায়। টিয়ার দাদি গত হয়েছে অনেক আগে। তবে দাদা রয়েছে। তাদের গাছের পাশেই আরেক গাছে রয়েছে ময়নারা। অনেক মিল-মহব্বত। টিয়ার ময়নার প্রতি প্রেম জমেছে বহুদিন। কিন্তু বলতে পারে না।
সূর্যের হাসিতে আজকের চমৎকার দিনটার শুরু। টিয়ার চোখে কিরণ পড়তেই বাসা থেকে বেরিয়ে ডানা ঝাঁপটে বসল বাসার সামনের ডালে। এমন সময় ময়নাও এল তাদের বাসায়। সম্ভবত তার মায়ের সঙ্গে কোনো কথা বলতে। টিয়া ডাক দিল ময়নাকে। টিয়ার ভালোবাসা বুঝতে পেরেও এড়িয়ে যায় ময়না। কিন্তু আজ না এড়িয়ে টিয়ার পাশে গিয়ে বসল। তাদের খোঁশগল্পের মাঝেই ডাক পড়ল টিয়ার দাদার। দুজনই গেল দাদার কাছে। দাদা বলল, ‘শোনো টিয়া দাদাভাই আমার, তোমরা বেশি বাইরে থেকো না। আর কথা বলারও প্রয়োজন নেই। আজকাল শিকারিদের আনাগোনা বেড়েছে। আমাদের ডাক শুনলেই হয়তো গুলি করবে।’ টিয়া, ময়না দুজনই দাদার কথায় হ্যাঁ সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়াল। এর পর দাদা তার যুবক বয়সের করুণ ইতিহাস বলতে লাগল টিয়াদের।
এক সময় এ বনে অনেক মাজরা পোকার বাস ছিল। যারা পাশে থাকা লোকালয়ের ধান খেতের অনেক ক্ষতি করত। ফলে অনেক অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল মানুষগুলো, আমরাও বের হতে পারতাম না আমাদের আঙিনায়। ডাক দিতে পারতাম না। এটা কি মানা যায়? তাই আমাদের বনকে পরিষ্কার করতে আমরা সব টিয়া, ময়না, বিড়াল আর মানুষ এক হয়ে এই মাজরা পোকাদের তাড়িয়ে দেওয়ার মিশনে নেমেছিলাম এবং আমরা সফলও হয়েছিলাম। ওই এলাকার মানুষগুলোও ছিল আমাদের সঙ্গে। মাজরা পোকাদের উচ্ছেদে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম। সেদিন সারা দিন উড়েছি গাছে গাছে। ময়নার দাদাও ছিল আমার সঙ্গে। মনে হয়েছিল আমরা এবার মুক্ত হয়ে গেছি। আর কোনো পোকামাকড়ের ঝিঁঝিঁ বিশ্রী শব্দে আমাদের ডাক নিভে যাবে না। পুরো বন মুখরিত হবে টিয়া-ময়নাদের ডাকে। আমরা আবার কথা বলব আমাদের সুরে, প্রাণ খুলে।
আমাদের এ সুখ টিকল না বেশি দিন। যেন দুখী হয়েই জন্ম আমাদের। পাশের এলাকার মানুষ নামের অমানুষগুলোর ফাঁদে আমাদের পড়তে হয়েছে খুব শিগগিরই। পরিবারের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে। ছিল না প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফেরার সামান্যটুকু আশা। জানিস টিয়া, তখন তোর দাদুর প্রেমে পড়েছিলাম। বিয়াটা হয়নি তখনো। আমাকে আর ময়নার দাদাকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওই কুৎসিত মানুষগুলো। তখন তোর দাদু গাছে গাছে উড়ে উড়ে ডাকছিল শুধু। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি।
তারা আমাদের খাঁচায় বন্দি করে ফেলল। তাদের বাচ্চাদের বিনোদনের খোরাক হয়ে গেলাম যেন আমরা। তারা আমাদের তাদের ভাষা শেখাতে লাগল। এ জন্যই কি আমরা মাজরা পোকাদের তাড়িয়েছিলাম? আর সহ্য হলো না। তাদের কথা শিখলাম আমরা। এর পর একদিন আমি আর ময়নার দাদা একসঙ্গে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ডাক দিয়ে উঠলাম। তখনই কয়েকটি বিড়ালসহ আমরা খাঁচা ভেঙে উড়ে চলে এসেছি। তারা আমাদের তাদের খাঁচায় আটকে রাখতে পারেনি। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নিয়েছি। এর পর দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীন হয়েছি।
টিয়া বলে উঠল, না দাদা। আমরা এখনো স্বাধীন হতে পারিনি। যে কাজটা একসময় মাজরা পোকা আর অমানুষরা করত। তা এখন করছে তখনকার বিড়ালের কুৎসিত সন্তানরা। আমরা এখনো কথা বলতে যে পারি না দাদা। এখন মানুষ নয়। আমাদের স্বীকার করতে ওত পেতে থাকে বিড়ালরা। আমরা যখন কথা বলতে চাই, তখনই আমাদের জিহ্বাকে টেনে বের করতে চায় বিড়ালরা। আমরা যে এখন স্বাধীনতার নামে পরাধীন। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না। নিজের অধিকারের কথা, সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারি না আমরা। দাদা, চলছে বিড়ালবিরোধী আন্দোলন। আমরা আবার যাব আন্দোলনে, বিড়াল রাজার পতন দেখব দাদা। আবার আমরা মনের সুখে ডালে ডালে উড়ব, গান গাইব, কথা বলব, ডাকব ইচ্ছেমতো।
কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে পড়ল টিয়া। পেছন থেকে তাকিয়ে ছিল ময়না। ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে অভিনয় করতে থাকা টিয়াকে যে সে অন্তর থেকে ভালোবাসে। তার টিয়া যে যাচ্ছে বুলেট, বোমার সম্মুখে। না চাইতেই গড়িয়ে পড়ল ময়নার চোখের জল। শুধু একটা কথাই বলেছিল, ‘ফিরে এসো টিয়া’।
কিন্তু টিয়া আর ফিরল না। বিড়াল রাজার হুকুমে টিয়ার গলায় কামড় বসাল বিড়ালরা। তার রক্তের স্রোতে চোখ ভিজল তার। টিয়ার প্রতিটা হাড্ডিতে কামড় বসিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নিল রাক্ষস বিড়াল। তারা যে অভুক্ত ছিল বহুকাল। তারা যে রক্তের স্রোতে গা ভেজাতে অভ্যস্ত, এটাই তাদের স্বভাব। তাই তারা অস্তিত্ব বিলীন করতে চাইল টিয়া আর ময়নাদের। কিন্তু না, পারেনি তারা, শত শত হাজার হাজার পাখির বুকের সামনে তাদের বুলেট হয়ে গেছে অকেজো। টিয়াদের রক্তের বিনিময়ে উঠেছে নতুন সূর্য, হয়েছে নতুন দিনের শুরু।
এ এস এম সায়েম
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ
তারেক