ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

পাঠকের লেখা : টিয়াদের নতুন সূর্যোদয়

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৬ পিএম
পাঠকের লেখা : টিয়াদের নতুন সূর্যোদয়
ছবি: সংগৃহীত

চলছে বিড়ালদের বিদ্রোহ। দীর্ঘদিন ধরে অভুক্ত থাকার মতো ধৈর্য তাদের কুলায় না। মাছের কাঁটা, গরুর হাড্ডি কিছুই তো পাচ্ছে না অনেক দিন। রাজ্যে যে বসন্তের বাতাস বইছে। কিন্তু এত বসন্তের ফুল দেখে কী লাভটা হবে বলেন তো? যদি না পায় তারা মাছের কাঁটা কিংবা হাড্ডি।

পথে, মাঠে, ঘাটে বেরিয়ে পড়েছে, স্লোগান তুলছে ‘হাড্ডি চাই, কাঁটা চাই, হাড্ডি চাই, কাঁটা চাই’। বিড়াল রাজা পড়লেন মহা মুশকিলে!

ললিত বনের চন্দন গাছটায় টিয়া পরিবারটার বাসস্থান। কত ঝড় এল-গেল, তাদের সরাতে পারেনি। তিন প্রজন্মের বাস তাদের একই বাসায়। টিয়ার দাদি গত হয়েছে অনেক আগে। তবে দাদা রয়েছে। তাদের গাছের পাশেই আরেক গাছে রয়েছে ময়নারা। অনেক মিল-মহব্বত। টিয়ার ময়নার প্রতি প্রেম জমেছে বহুদিন। কিন্তু বলতে পারে না।

সূর্যের হাসিতে আজকের চমৎকার দিনটার শুরু। টিয়ার চোখে কিরণ পড়তেই বাসা থেকে বেরিয়ে ডানা ঝাঁপটে বসল বাসার সামনের ডালে। এমন সময় ময়নাও এল তাদের বাসায়। সম্ভবত তার মায়ের সঙ্গে কোনো কথা বলতে। টিয়া ডাক দিল ময়নাকে। টিয়ার ভালোবাসা বুঝতে পেরেও এড়িয়ে যায় ময়না। কিন্তু আজ না এড়িয়ে টিয়ার পাশে গিয়ে বসল। তাদের খোঁশগল্পের মাঝেই ডাক পড়ল টিয়ার দাদার। দুজনই গেল দাদার কাছে। দাদা বলল, ‘শোনো টিয়া দাদাভাই আমার, তোমরা বেশি বাইরে থেকো না। আর কথা বলারও প্রয়োজন নেই। আজকাল শিকারিদের আনাগোনা বেড়েছে। আমাদের ডাক শুনলেই হয়তো গুলি করবে।’ টিয়া, ময়না দুজনই দাদার কথায় হ্যাঁ সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়াল। এর পর দাদা তার যুবক বয়সের করুণ ইতিহাস বলতে লাগল টিয়াদের।

এক সময় এ বনে অনেক মাজরা পোকার বাস ছিল। যারা পাশে থাকা লোকালয়ের ধান খেতের অনেক ক্ষতি করত। ফলে অনেক অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল মানুষগুলো, আমরাও বের হতে পারতাম না আমাদের আঙিনায়। ডাক দিতে পারতাম না। এটা কি মানা যায়? তাই আমাদের বনকে পরিষ্কার করতে আমরা সব টিয়া, ময়না, বিড়াল আর মানুষ এক হয়ে এই মাজরা পোকাদের তাড়িয়ে দেওয়ার মিশনে নেমেছিলাম এবং আমরা সফলও হয়েছিলাম। ওই এলাকার মানুষগুলোও ছিল আমাদের সঙ্গে। মাজরা পোকাদের উচ্ছেদে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম। সেদিন সারা দিন উড়েছি গাছে গাছে। ময়নার দাদাও ছিল আমার সঙ্গে। মনে হয়েছিল আমরা এবার মুক্ত হয়ে গেছি। আর কোনো পোকামাকড়ের ঝিঁঝিঁ বিশ্রী শব্দে আমাদের ডাক নিভে যাবে না। পুরো বন মুখরিত হবে টিয়া-ময়নাদের ডাকে। আমরা আবার কথা বলব আমাদের সুরে, প্রাণ খুলে।

আমাদের এ সুখ টিকল না বেশি দিন। যেন দুখী হয়েই জন্ম আমাদের। পাশের এলাকার মানুষ নামের অমানুষগুলোর ফাঁদে আমাদের পড়তে হয়েছে খুব শিগগিরই। পরিবারের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে। ছিল না প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফেরার সামান্যটুকু আশা। জানিস টিয়া, তখন তোর দাদুর প্রেমে পড়েছিলাম। বিয়াটা হয়নি তখনো। আমাকে আর ময়নার দাদাকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওই কুৎসিত মানুষগুলো। তখন তোর দাদু গাছে গাছে উড়ে উড়ে ডাকছিল শুধু। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি।

তারা আমাদের খাঁচায় বন্দি করে ফেলল। তাদের বাচ্চাদের বিনোদনের খোরাক হয়ে গেলাম যেন আমরা। তারা আমাদের তাদের ভাষা শেখাতে লাগল। এ জন্যই কি আমরা মাজরা পোকাদের তাড়িয়েছিলাম? আর সহ্য হলো না। তাদের কথা শিখলাম আমরা। এর পর একদিন আমি আর ময়নার দাদা একসঙ্গে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে ডাক দিয়ে উঠলাম। তখনই কয়েকটি বিড়ালসহ আমরা খাঁচা ভেঙে উড়ে চলে এসেছি। তারা আমাদের তাদের খাঁচায় আটকে রাখতে পারেনি। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নিয়েছি। এর পর দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীন হয়েছি।

টিয়া বলে উঠল, না দাদা। আমরা এখনো স্বাধীন হতে পারিনি। যে কাজটা একসময় মাজরা পোকা আর অমানুষরা করত। তা এখন করছে তখনকার বিড়ালের কুৎসিত সন্তানরা। আমরা এখনো কথা বলতে যে পারি না দাদা। এখন মানুষ নয়। আমাদের স্বীকার করতে ওত পেতে থাকে বিড়ালরা। আমরা যখন কথা বলতে চাই, তখনই আমাদের জিহ্বাকে টেনে বের করতে চায় বিড়ালরা। আমরা যে এখন স্বাধীনতার নামে পরাধীন। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না। নিজের অধিকারের কথা, সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারি না আমরা। দাদা, চলছে বিড়ালবিরোধী আন্দোলন। আমরা আবার যাব আন্দোলনে, বিড়াল রাজার পতন দেখব দাদা। আবার আমরা মনের সুখে ডালে ডালে উড়ব, গান গাইব, কথা বলব, ডাকব ইচ্ছেমতো।

কিছুক্ষণ পরই বের হয়ে পড়ল টিয়া। পেছন থেকে তাকিয়ে ছিল ময়না। ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে অভিনয় করতে থাকা টিয়াকে যে সে অন্তর থেকে ভালোবাসে। তার টিয়া যে যাচ্ছে বুলেট, বোমার সম্মুখে। না চাইতেই গড়িয়ে পড়ল ময়নার চোখের জল। শুধু একটা কথাই বলেছিল, ‘ফিরে এসো টিয়া’।

কিন্তু টিয়া আর ফিরল না। বিড়াল রাজার হুকুমে টিয়ার গলায় কামড় বসাল বিড়ালরা। তার রক্তের স্রোতে চোখ ভিজল তার। টিয়ার প্রতিটা হাড্ডিতে কামড় বসিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নিল রাক্ষস বিড়াল। তারা যে অভুক্ত ছিল বহুকাল। তারা যে রক্তের স্রোতে গা ভেজাতে অভ্যস্ত, এটাই তাদের স্বভাব। তাই তারা অস্তিত্ব বিলীন করতে চাইল টিয়া আর ময়নাদের। কিন্তু না, পারেনি তারা, শত শত হাজার হাজার পাখির বুকের সামনে তাদের বুলেট হয়ে গেছে অকেজো। টিয়াদের রক্তের বিনিময়ে উঠেছে নতুন সূর্য, হয়েছে নতুন দিনের শুরু।

 

এ এস এম সায়েম
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ

 

 

তারেক

গ্রাফোলজি: মানুষ চেনাবে হাতের লেখা

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
গ্রাফোলজি: মানুষ চেনাবে হাতের লেখা
ছবি: আদিব আহমেদ

নায়ক রাজ রাজ্জাক অভিনীত ‘যে আগুনে পুড়ি’ সিনেমার জনপ্রিয় ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটির কথা মনে আছে? আসলেই কি চোখ মনের কথা বলতে পারে? সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় হয়তো পারে কিন্তু চোখ মনের কথা বলতে পারুক আর না পারুক আপনার হাতের লেখা আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই বলে দিতে পারে। বিজ্ঞানে যাকে বলা হয় গ্রাফোলজি। আধুনিক বিজ্ঞানে যাকে নিউরোসায়েন্স বলা হয় যদিও সায়েন্স তকমা দেওয়া নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। 

যারা আগে থেকে ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত নন তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ‘বলা নেই কওয়া নেই এ আবার কোন বিজ্ঞান?’ কিন্তু আপনি হয়তো জেনে অবাক হবেন যে, এটি হাজার বছরের পুরোনো একটি কৌশল। শত শত বছরের হাতের লেখা গবেষণার ফসল আজকের এই গ্রাফোলজি।

গ্রাফোলজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। গ্রাফ অর্থ লেখা আর লোজি অর্থ বিশ্লেষণ। গ্রাফোলজি অর্থ হস্তলেখা বা হাতের লেখা বিশ্লেষণ। 

গ্রাফোলজির ইতিহাস অনেক পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে চীনা দার্শনিক কুও জো সু একটি মহামূল্যবান উক্তি করেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে হাতের লেখা দাও, আমি বলে দেব সেটা মহান ব্যক্তির না অমার্জিত ব্যক্তির।’ গ্রাফোলজি নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণা থাকলেও ১৬২২ সালে ইতালির প্রফেসর ড. ক্যামিলো বাল্ডি তার বই প্রকাশের মাধ্যমে গ্রাফোলজিকে সংগঠিত করেন। 

বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা যখন কিছু লিখি তা মূলত নির্দেশনা আসে মস্তিষ্ক থেকে, যার ফলে আপনার মস্তিষ্কের মধ্যে যা ঘুরপাক খাচ্ছে তার একটা প্রতিফলন ঘটে লেখার মাধ্যমে। গ্রাফোলজি গবেষকদের মতে নির্দিষ্ট কিছু আচরণের মানুষের মধ্যে একই রকমের লিখার ধরনের মিল থাকে। যেমন- ইংরেজি ছোট হাতের t-এর ক্রস যারা একদম উপরে দেয় তারা মূলত উচ্চাভিলাষী এবং সবকিছুতে আশাবাদী হয়ে থাকে। তাদের আত্মসম্মানবোধ অন্যদের তুলনায় একটু বেশি হয়। আবার যাদের ইংরেজি হাতের অক্ষর a, o-এর মুখ খোলা থাকে তারা একটু বাঁচাল প্রকৃতির হয়ে থাকে। আবার যাদের ইংরেজি d বর্ণের লুপ (d-এর উপরের গোলাকার অংশটিকে লুপ বলা হয়) বেশি তারা সমালোচনা নিতে পারেন না।

হাতের লেখার কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন- Margin, Baseline, Slant, Size, Pastocity, Connection, Spacing, Zones, Pressure, Speed, Individual Letters ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে আপনি অতীত, পরিবার ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কতটুকু ভাবেন তা নির্ণয় করা সম্ভব। কেউ কতটুকু আবেগপ্রবণ বা বাস্তববাদী তাও হাতের লেখা দেখে বলা সম্ভব। এই রকম একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের অনেকগুলো বিষয় ইনট্রোভার্ট না এক্সট্রোভার্ট, রাগী না শান্ত, সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী, ধৈর্যশীল না অধৈর্যশীল ইত্যাদি গ্রাফোলজির মাধ্যমে জানা সম্ভব।

গ্রাফোলজি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। নিচে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার উল্লেখ করা হলো-


১. মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থান
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয় গ্রাফোলজি, বিশেষত যখন কোনো প্রার্থীচাকরির জন্য উপযুক্ত কি না, তা মূল্যায়ন করা হয়। হাতের লেখার মাধ্যমে প্রার্থীর মনোভাব, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা এবং মানসিক গঠন বোঝা যায়।

২. শিক্ষা ও ক্যারিয়ার পরামর্শ
ছাত্রছাত্রীদের হাতের লেখা বিশ্লেষণ করে তাদের মানসিক প্রবণতা, শক্তি এবং দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায়। এর মাধ্যমে সঠিক পেশা বা শিক্ষার দিক নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য এবং থেরাপি
মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ডিপ্রেশন ইত্যাদি মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য গ্রাফোলজি ব্যবহার করা হয়। এটি একজন ব্যক্তির আবেগীয় অবস্থা এবং মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।

৪. ফরেনসিক এবং তদন্ত (ফরেনসিক গ্রাফোলজি)
অপরাধ তদন্তে ফরেনসিক গ্রাফোলজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো নথি বা চিঠি আসল কি না বা অপরাধীর মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, তা বিশ্লেষণ করা যায়।

৫. ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন
ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা আত্মোন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রাফোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেয়।

৬. ব্যক্তিগত উন্নতি
নিজের লেখার ধরন বিশ্লেষণ করে আচরণগত পরিবর্তনের চেষ্টা করা যায়। এর মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। হাতের লেখা শুধু শব্দ নয় বরং আমাদের মনের এক গভীর প্রতিচ্ছবি। আপনি যদি এই গ্রাফোলজি বিদ্যা সম্পর্কে জানতে চান তাহলে একজন দক্ষ গ্রাফোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে গ্রাফোলজি কোর্স করতে পারেন। 


লেখক: গ্রাফোলজিস্ট ও ফরেনসিক ডকুমেন্ট এক্সামিনার

 

তারেক

বাংলাদেশে গ্রাফিতি

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
বাংলাদেশে গ্রাফিতি
অনেকের মতে সুবোধই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রাফিতি। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও একসময় সুবোধের গ্রাফিতি ঝড় তোলে। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ হয়ে আসছে। সে সময় প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান এ ধারা শুরু করেন। তারপর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন পর্যন্ত শিল্পীরা গ্রাফিতি এঁকেছেন। দেশের যেকোনো আন্দোলনে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। দেয়ালে কিছু উপস্থাপন করলে মানুষকে সেটা আকর্ষণ করে। তাই প্রতিবাদের একটা অন্যতম হাতিয়ার হলো গ্রাফিতি।

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক। তখন ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ শিরোনামে এক আলোচিত গ্রাফিতি ছিল। কিন্তু আজ হয়তো অনেকেই সেই আইজুদ্দিনকে ভুলে গেছে। সে সময় পুরোনো ঢাকার দেয়ালে, নীলক্ষেত, দোয়েল চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এলাকার সীমানাপ্রাচীরসহ বিভিন্ন জায়গায় ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ দেখা যেত। অন্য জেলায়ও আইজুদ্দিন তার কষ্ট ছড়িয়ে ছিলেন।

এখনো পার্কের বেঞ্চে, গাছের গায়ে লেখা থাকে ‘অমুক+অমুক’। অথবা টাকার ওপর লেখা থাকে ‘সাথী তোমারে ভুলি নাই’। এই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তিন দশকেরও বেশি আগে কষ্টে জীবন কাটানো আইজুদ্দিনদের কষ্ট বোঝা অনেক কঠিন। অনেকে খোঁজ করেছেন কে এই আইজুদ্দিন? কেন তিনি কষ্টে আছেন? তার কীসের কষ্ট? খাওয়ার, অর্থের বেকারত্বের নাকি প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ার? নাকি তিনি একজন কষ্টবিলাসী শিল্পী! গ্রাফিতি শিল্পীরা রহস্যময়। তাদের প্রায় কোনো কিছুই জানা যায় না। 

এরপর চলে যায় অনেক দিন। সেটা ২০১৭ সালের কথা। তখন একদিন মিরপুরের দেয়ালে দেয়ালে ‘সুবোধ’ নামে একের পর এক গ্রাফিতি দেখা যায়। অনেকে মনে করেন সুবোধই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রাফিতি। এটা এত জনপ্রিয় হয় যে, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সুবোধের গ্রাফিতি দেখা যায়। অনেকের প্রোফাইল ও গেঞ্জিতেও ‘সুবোধ’ ছিল। এর ভাষা ছিল, ‘সুবোধ ভোর হবে কবে’। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা এখন সময় পক্ষে না’। ‘তোর ভাগ্যে কিছু নেই। মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’। ‘সুবোধ এখন জেলে’ ইত্যাদি। 

কিন্তু কেউ জানে না কারা এটা এঁকেছিল। তবে সুবোধ মানুষের ভাবনার জগতে আলোড়ন তোলে। মানুষ ভাবে, কে এই সুবোধ। কেন সে পালিয়ে বেড়ায়। পালালেও নগরের দেয়ালে রেখে যায় চিহ্ন। কেন তাকে কেউ ভালোবাসে না। অনেকেই এর অঙ্কনশিল্পীর পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু অজানাই থেকে যায় তার পরিচিতি। গ্রাফিতি এমনই হয়। প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বাতাসে। আর থেকে যায় মানুষের অন্তরে অগোচরে।

২০১০ সালের এক ঘটনা। সে সময় ‘আবু বকর’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলে। সে বছরের ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় দুই পক্ষের গোলাগুলি। তখন আবু বকর মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তারপর ৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে তার গ্রাফিতি দেখা যায়।

২০১৮ সালে আবার এক ঘটনা ঘটে। তখন সলিমুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী ছিলেন এহসান রফিক। তাকে নির্যাতন করে চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৯ সালে বুয়েটের শিক্ষার্থী ফাহাদ আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে রফিকের নির্যাতন ও আবরারের মৃত্যুর প্রতিবাদ দেখা যায়।

বিশ্ব ইতিহাসে গ্রাফিতি 

গ্রাফিতির ইতিহাস অনেক পুরোনো। ঠিক কবে, কখন এর শুরু তা বলা কঠিন। অনেকে মনে করেন পশুর হাড় দিয়ে গুহায় খোদাই করেই প্রথম গ্রাফিতি আঁকা হয়। তবে  প্রাচীন রোমে সমাধির দেয়াল, সিরিয়া, জর্ডান ও সৌদি আরবে গ্রাফিতি দেখা যায়। সে সময়ও গ্রাফিতি বেশ অর্থপূর্ণ ছিল। সেখানে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা থাকত। সেই থেকে বিভিন্ন দেশের তরুণরা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি গ্রাফিতি দেখা যায়। তখন আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল টেকো মাথার এক লোক দেয়াল ধরে বসে আছেন। সেখানে লেখা ছিল ‘KilRoy Was HERE’। তখন আবার আমেরিকার এক জাহাজ জার্মানদের হাতে ধরা পড়ে। তাই হিটলার ভাবলেন এটা নিশ্চয়ই আমেরিকানদের কোনো হাই ইন্টেলিজেন্সের কোডনেম। অথচ আজও অজানা এই কিলরয়ের রহস্য।

১৯৬৮ সালের এক ঘটনা। ফ্রান্সে তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য। সে বছরের মে মাসের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। তারা গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। বিপ্লব আরও বেগবান হয়। শিক্ষার্থীরা জীবন দেন। কিন্তু আন্দোলন থেকে ফেরেন না। একসময় সরকারের পতন হয়। দুনিয়াজুড়ে সেদিনের সফলতার খবর ছড়িয়ে পড়ে।

এরিক ক্ল্যাপটন তখন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রক গিটারিস্ট, গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। তাকে মনে করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গিটারিস্টদের একজন। সেটা ছিল ১৯৬৭ সাল। লন্ডনের ইসলিংটন স্টেশনের দেয়ালে ‘ক্ল্যাপটন ইজ গড’ নামে এক গ্রাফিতি দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীতে সেটিই ছিল নাকি বিশ্বের সেরা গ্রাফিতি। 

গ্রাফিতি শিল্পীরা সাধারণত পরিচয় গোপন রাখেন। এরা হলেন অন্তর্মুখী শিল্পী। ইংল্যান্ডের বাংসি ছিলেন একজন বিখ্যাত পথ গ্রাফিতি শিল্পী। তিনি রাজনৈতিক ও যুদ্ধবিরোধী গ্রাফিতির জন্য বিখ্যাত। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত তার গ্রাফিতি দেখা যেত। ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর নিয়ে তিনি বিদ্রুপমূলক গ্রাফিতি এঁকেছেন। 
তবে অনেকে মনে করেন অন্যের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে গ্রাফিতি দিয়ে সৌন্দর্য নষ্টের অধিকার কারও নেই। আবার কখনো পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়। কখনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠীও গ্রাফিতির মাধ্যমে জানান দেয়। পোস্টার লাগায়। নেতা-নেত্রীর বন্দনায় দেয়াল ভরে ফেলে। 

কলকাতার লেখক বীরেন দাশ শর্মা তার ‘গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প’ গ্রন্থে গ্রাফিতি নিয়ে লিখেছেন যে ‘এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শামসুন্নাহার হলের নির্যাতন’ নিয়ে আঁকা ড্রাগন গ্রাফিতি প্রশংসা পায়। ষাটের দশকে হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতা’র বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...।’ প্রায় দশকের পর দশক জনপ্রিয় ছিল।

 

তারেক

যে শহরে মানুষের চেয়ে গাছ বেশি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১১ পিএম
যে শহরে মানুষের চেয়ে গাছ বেশি
ছবি: সংগৃহীত

গাছ আমাদের পরম বন্ধু, মানুষ ও পরিবেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অর্থের জোগানদাতা হিসেবে বৃক্ষের অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমনি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালার ভূমিকা অনেক। বাতাস থেকে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছেড়ে দিই।

অন্যদিকে গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। সুতরাং মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গাছপালার অবদান অপরিসীম। শুনলে হয়তো অবাকই হবেন যে, পৃথিবীতে এমন এক শহর রয়েছে যেখানে মানুষের চেয়ে গাছের সংখ্যা বেশি। 

যুক্তরাজ্যের সাউথ ইয়র্কশায়ার কাউন্টির বৃহত্তম শহর শেফিল্ড। নদী আর উপত্যকায় ঘেরা সবুজময় এক শান্তির শহর। অথচ এ শহরেই রয়েছে ৪২৫ টন ওজন ও ১২ হাজার হর্সপাওয়ারের রিভার ডন ইঞ্জিন। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী একটি কার্যকরী স্টিম ইঞ্জিন থাকা সত্ত্বেও শেফিল্ড একটি শীতলতম শহর। যেখানে মানুষের চেয়ে গাছের সংখ্যা অনেক বেশি।

পাহাড়ঘেরা শেফিল্ডের আশপাশ ঘিরে রয়েছে সাতটি চূড়া ও সুদৃশ্য উপত্যকা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে এখানে প্রবাহিত হচ্ছে ডন নদী ও এর চারটি উপনদী শেফ, রিভলিন, লক্সলে এবং পোর্টার ব্রুক। এ কারণেই ১২ শতকের প্রথম থেকে শত শত শিল্প-কারখানা এখানে গড়ে ওঠে, যেগুলোয় শেফিল্ড কাটলারি ও ছুরি-ব্লেডের মতো 
ছোট ইস্পাতের উপকরণ উৎপাদন হয়ে আসছে। এ কারণে শহরটির নাম হয়ে ওঠে ‘দ্য স্টিল সিটি’।

শিল্প শহর হওয়া সত্ত্বেও কী করে শহরটি এখনো শীতল! ব্রিটেনের সবুজতম শহরটির কেন্দ্রে রয়েছে ৬১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে পার্ক, বনভূমি আর পরিকল্পিত দর্শনীয় বাগান। শহরজুড়ে সাড়ে ৫ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে রয়েছে ৪৫ লাখের বেশি গাছ। শহরটির এক-পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে গাছের বসবাস। শহরের প্রতি বাসিন্দার বিপরীতে রয়েছে কমপক্ষে ৮০টি গাছ। এ কারণে ২০২২ সালে শেফিল্ডকে বিশ্বের অন্যতম আন্তর্জাতিক ট্রি সিটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের সবুজতম শহর হওয়ার পাশাপাশি শেফিল্ডকে অসলোর পরে ইউরোপের দ্বিতীয় সবুজ শহরের তকমা দিয়ে ইয়র্কশায়ারকে গৌরবান্বিত করেছে।

শহরটিতে রয়েছে ৮০০টি সবুজ স্থান, রয়েছে ১৫ মাইল এলাকাজুড়ে গাছবেষ্টিত একটি ওয়াকওয়ে রুট। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশকিছু জলাধার- যেগুলোয় হংসমিথুনের জলকেলি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় দর্শনার্থীদের। অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় ১২ শতকের শুরুর দিকে যে শহরটিকে মনে হয়েছিল ইংল্যান্ডের উষ্ণতম শহর হবে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আশ্চর্যজনকভাবে এটি হয়ে উঠেছে শীতলতম সবুজ শহর। 

 

তারেক

ইতালীয়রা নিজেদের ইতালীয় মনে করেন না!

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
ইতালীয়রা নিজেদের ইতালীয় মনে করেন না!
ছবি: সংগৃহীত

ইতালি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য এক হওয়ার মাধ্যমে। তাই ইতালিতে কোনো স্বাধীনতা দিবস নেই, যা আছে তা হলো একত্রীকরণ দিবস।

১৮১৫ সাল থেকেই ইতালিকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৫ বছর পর ১৮৭০ সালে ক্যামিও ক্যাভোর ও জিউসেপ গরিবল্ডির নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইতালি। মেডিটেরিনিয়ান অঞ্চলে নগরভিত্তিক রাষ্ট্রের চল শুরু হয় আরও তিন হাজার বছর আগে থেকেই। কিন্তু একসময় একত্রীকরণের মাধ্যমে পৃথিবীর বড় একটা অংশ মিলে গড়ে ওঠে রোম সাম্রাজ্য। সেই রোম সাম্রাজ্যেরও পতন হয় একদিন। আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সব। ছোট ছোট একেকটা নগর রাষ্ট্র তৈরি হয়। এরপর আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো কতগুলো নগর রাষ্ট্র নিয়ে গড়ে ওঠে ইতালি; যদিও তা রোম সাম্রাজ্যের মতো বড় নয়।

ইতালি কিছু ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বা অঞ্চলে বিভক্ত। যেমন- মিলান, রোম, নেপলস, বোলোনিয়া, পালের্মো ইত্যাদি। এসব অঞ্চলের ভেতর রয়েছে অনেক ভিন্নতা। পোশাক, খাবার, বিয়ের রীতি থেকে শুরু করে ভিন্নতা রয়েছে প্রার্থনা রীতিতেও। এক অঞ্চলের মানুষ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেন তো, আরেক অঞ্চলের মানুষ ইংরেজি বোঝেনই না। এক অঞ্চলের মানুষের কাছে পিৎজা সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার তো, আরেক অঞ্চলের মানুষ নাক সিঁটকিয়ে বলেন পিৎজা তো গরিব ছোটলোকের খাবার। হয়তো সেই ভিন্নতার কারণেই তারা নিজেদের ইতালীয় মনে করেন না। যে যেই নগর রাষ্ট্রের বা অঞ্চলের নাগরিক, সে তাকে সেই রাষ্ট্রেরই মনে করেন। যেমন- রোমান, মিলানিজ, নেপলিজ ইত্যাদি। শুধু চার বছরে একবার তারা সবাই নিজেদের ইতালীয় মনে করেন। আর তা হলো বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময়!

ইতালিয়ানদের ভেতর সবচেয়ে প্রকট যেই ভিন্নতা, তা হলো মানসিক ভিন্নতা। প্রতিটি অঞ্চলের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকে সব সময়। যে যেই অঞ্চলের সে মনে করেন, তার অঞ্চল সবদিক থেকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ, তার জাতি সবচেয়ে উঁচু শ্রেণির জাতি। এরা যেমন নিজেদের অঞ্চলের খাবার খুব পছন্দ করেন, প্রশংসা করেন, একই সঙ্গে অন্য অঞ্চলগুলোর খাবার অপছন্দ করেন তো বটেই, রীতিমতো ঘৃণা করেন। যেমন- রোমে পাস্তা জনপ্রিয়, নেপলসে জনপ্রিয় পিৎজা। নেপলস ব্যতীত অন্য অঞ্চলের মানুষ পিৎজা পছন্দই করেন না। এত এত বৈপরীত্য যাদের ভেতর প্রবল, তারা নিজেদের এক জাতি কিংবা এক দেশের নাগরিক মনে করবেন না, এটাই বোধহয় স্বাভাবিক!

 

তারেক

হাতির বাংলো

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
হাতির বাংলো
ছবি: লেখক

চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবির পাহাড় আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। চারপাশে উঁচু পাহাড়, সবুজের সমারোহ ও পাখির কিচিরমিচির শব্দে মন ভরে উঠবে যে কারও। এই পাহাড় ধরেই দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে একটি হাতি শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখে যে কারও মনে হতে পারে এটি একটি সত্যিকারের হাতি।

বিশাল দূর থেকে জীবিত মনে হলেও, সামান্য কাছে যেতেই দেখা মিলবে হাতির আদলে নির্মিত ১৩১ বছরের পুরোনো একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। দেখতে অবিকল হাতির মতো মনে হলেও এটি মূলত ইট-পাথরে নির্মিত একটি প্রাচীন ভবন। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘হাতির বাংলো’ নামেও পরিচিত। হাতির বাংলো চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে সামান্য উপরে অবস্থিত, যা স্থানীয় জনগণের কাছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। এটি মূলত একটি বিশাল বাংলো, যা ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়। 

লোককথা অনুসারে, এই স্থানে ব্রিটিশদের হাতি প্রশিক্ষণের একটি ঘাঁটি ছিল। বাংলোর নিকটবর্তী এলাকায় হাতির আনাগোনা এতটাই বেশি ছিল যে, স্থানীয়রা এটি হাতির বাংলো নামে অভিহিত করতে শুরু করে।

১৮৯৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয় ব্রিটিশ প্রকৌশলী ব্রাউনজারের অধীনে। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্যই বাংলোটি নিজেই নির্মাণ করেন প্রকৌশলী ব্রাউনজার। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এবং বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতো এটি। দেশভাগের পর এটি স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে চলে আসে এবং ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। 

হাতির বাংলোর স্থাপত্যশৈলী ব্রিটিশ স্থাপত্যের সঙ্গে স্থানীয় শৈলীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এর লাল ইটের দেয়াল, বড় বড় বারান্দা, উঁচু ছাদ এবং প্রশস্ত ঘরগুলো এখনো সেই সময়ের নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে। বাংলোর চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং ফুলের বাগান এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

তবে কালের আবহমানে বাংলোটি আজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বাংলোটির সামনে ও পেছনের অংশ মিলিয়ে মোট ১২টি গোলাকৃতির জানালা আছে। এ ছাড়া হাতির শুঁড়ের আদলে নির্মিত বারান্দার দুই পাশেও আছে গোলাকার দুটি ছিদ্র, যা দেখতে অনেকটাই হাতির চোখের মতো। ডুপ্লেক্স এই ভবনের নিচতলায় চারটি ও দোতলায় একটি শয়নকক্ষ আছে। বর্তমানে স্থাপনাটির সবক’টি দরজা-জানালাই ভেঙে পড়ার পাশাপাশি মরিচা ধরেছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ এই হাতির বাংলো পড়ে আছে অনেকটা জীর্ণশীর্ণ অবস্থায়। নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ, ফলে হারাতে বসেছে বাংলোটির সৌন্দর্য। এ ছাড়া ভবনের দেয়ালজুড়ে পড়েছে শ্যাওলা, খসে পড়তে শুরু করেছে পলেস্তারা। বাড়ির চারপাশজুড়ে জমে আছে বিভিন্ন ময়লা আর শুকনো পাতা। নান্দনিক এই বাংলোতে এখন একজন রেলওয়ে কর্মচারী থাকেন। বিকেল হলেই অনেক দর্শনার্থী হাতির বাংলো দেখতে ছুটে আসেন। ছবি তোলার পাশাপাশি এখানে অনেক সময় অনেকে বিভিন্ন শর্টফিল্মের শুটিংও করে থাকেন। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে ‘ফেরো’ সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত এই বাংলোর ১৩২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বেশ মজবুত অবস্থায় আছে।

হাতির বাংলো ভ্রমণের জন্য বছরের যেকোনো সময়ই উপযুক্ত। তবে বর্ষাকালে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। হাতির বাংলো শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত সাক্ষী।

 

 

তারেক