যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি তার একটি উক্তিতে বলেছেন, ‘উপর মহলের মানুষ থেকে আমরা খুব কমই উপহার পাই। এগুলো আসে নিচু স্তরের মানুষের কাছ থেকে’। উক্তিটি পর্যালোচনা করলে এমন অসংখ্য মানুষের চেহারা ভেসে উঠবে আমাদের চোখে। বড় বড় দালান আর বাড়ি-গাড়ি থাকলেই মানুষ মহৎ হয় না, যদি মানুষের আদর্শ ঠিক না থাকে।
মানুষকে বইমুখী করতে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের পরিচালক, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যা করেছেন তা বইপ্রেমীরা আজীবন মনে রাখবেন। সমাজকে আলোকিত করতে মানুষকে বইয়ের দিকে অগ্রসর করতে এরপর যাদের নাম আসবে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই নিম্নমধ্যবিত্ত। মানুষগুলো দারিদ্র্য আর কষ্টে নিমজ্জিত হলেও তাদের স্বপ্ন ছিল সমাজকে সুন্দর করার। যাদের মধ্যে আছে, একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণিজন বইয়ের ফেরিওয়ালা পলান সরকার। যিনি রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ২০টিরও গ্রামে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। গুণী এই মানুষ ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করলেও পরবর্তী সময়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আরেক গুণিজনের ভালো কাজটি। যিনি বইপ্রেমীদের কাছে ‘বেচি দই কিনি বই’ নামে সুপরিচিত মানুষ। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক। যাকে ইতোমধ্যে সামাজিক কাজে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ ছাড়াও সামাজিক কাজকর্মে ধনী শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি আমাদের চোখে ভেসে না উঠলেও বংশপরম্পরায় ভালো মানুষের সন্ধান মিলে। তেমনি একজন মানুষ হলেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। যিনি কারও কাছে বইবন্ধু কারও কাছে বইয়ের ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত। তবে তার কাজ সবার চাইতে আলাদা। কেউ কেউ পাঠাগার তৈরি করে মানুষকে বইমুখী করার চেষ্টা করছে আবার কেউ কেউ পাঠাগারে বই বিলি করছেন। কাজী এমদাদুল হক খোকন তাদেরই একজন। তবুও উনি সবার চাইতে ভিন্ন। বাংলাদেশের পাঁচ শতাধিকেরও বেশি পাঠাগারে নিজস্ব অর্থায়নে বই বিলি করেন তিনি।
কাজী এমদাদুল হক খোকনের দেশের বাড়ি শরীয়তপুরে। জন্ম ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে। বাবা ময়মনসিংহে চাকরি করার সুবাদে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন এই জেলাতেই। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। বিএ পাস করেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা কলেজ থেকে। পৈতৃক বসতবাড়ি ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের প্রিয়কাটি গ্রামে। শিক্ষাজীবন পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। অবসরে যান ২০১৫ সালে। শরীয়তপুর দেশের বাড়ি হলেও মিরপুরে থাকেন ভাড়া বাসায়। তার বাবা জীবিত থাকাকালীন থাকে পরামর্শ দেন নিজেকে যেন সব সময় ভালো কাজে জড়িয়ে রাখেন। সেই থেকে তিনি মানুষের পরোপকারী বন্ধু। মানুষকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ২০১৬ সাল থেকে গ্রাম থেকে শহরে দেশের নানা প্রান্তে নিজস্ব অর্থায়নে বই বিলি করছেন। এমদাদের বাবা কাজী আব্দুল গণী ১৯৮০ সাল মৃত্যুবরণ করেন। মাতা আবেদা খাতুন মারা যান ২০১০ সালে। এরপর থেকে তিনি বাবার কথায় নিজেকে ভালো কাজে জড়িয়ে রেখেছেন। ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীসহ পারিবারিক সদস্য মোট চারজন। ছেলেমেয়ে দুজনেই পড়াশোনা করছেন। বইবন্ধুর সময় কাটে নামাজ আর বই বিলি করেই।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী পাঠাগারের সংখ্যা কম থাকলেও তার সহযোগিতা আর বই পেয়ে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নতুন নতুন পাঠাগার। একেক পাঠাগারে বই দিয়েছেন পাঁচ শতাধিকেরও বেশি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন পাঠাগারে অবিরত বই পাঠিয়ে চলছেন। পাঠাগারের বইয়ের চাহিদা আর পাঠকের বই শূন্যতা পূরণে পাঠাগারপ্রেমীদের অপর নাম কাজী এমদাদুল হক। এ পর্যন্ত দেশের ৫২০টি পাঠাগারে বই পাঠিয়েছেন ৩০ হাজারের মতো। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকা। এক পাঠাগারেই দিয়েছেন ৩ হাজার বই।
ময়মনসিংহের রানীগঞ্জ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি রোবায়েত হোসেন বলেন, আমাদের পাঠাগারে ৫ হাজারেরও বেশি বই থাকলেও ৩ হাজারই দিয়েছেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। পাশাপাশি দিয়েছেন নগদ অর্থ সহায়তা। তিনি আরও বলেন, তার বই পেয়েই আজ রানীগঞ্জ পাঠাগার একটি সমৃদ্ধশীল পাঠাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। স্যারের মতো মানুষ আছেন বলেই আমরা ভরসা পাই সামাজিক কাজ করতে। ঝালকাঠি সদরে অবস্থিত নারায়ণ মিস্ত্রি গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ চন্দ্র হালদার বলেন, এমদাদ ভাইয়ের মতো এমন মানুষ বাংলাদেশে আমি দেখি না। তিনি বাংলাদেশের পাঠাগারগুলো সমৃদ্ধিকরণে যা করছেন, তা আমাদের মনে থাকবে সারা জীবন। আমি চাই তিনি দীর্ঘজীবী হোন।
কুড়িগ্রাম উপজেলার সাতভিটা গ্রন্থনীড়ের প্রতিষ্ঠাতা দিনমজুর জয়নাল আবেদিন বলেন, স্যার আমার পাঠাগারেও দিয়েছেন তিন শতাধিক বই। তিনি বলেন, এমন মানুষ বাংলাদেশে আছে ভাবতে আমার অবাক লাগে। সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের সভাপতি আব্দুস ছাত্তার খান বলেন, নিজ উদ্যোগে দেশের পাঠাগারগুলোতে তিনি বই দিচ্ছেন। পাশাপাশি বুক শেলফ, আলমারি এবং নগদ অর্থ সহায়তা। তিনি যে বইগুলো পাঠান পাঠাগারগুলোতে সবগুলো বইয়েই নামি-দামি প্রকাশনীর এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন। তিনি যে পরিমাণ অনুদান এবং বই দেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও তেমন সহযোগিতা করে না।
তিনি আরো বলেন, কাজী এমদাদুল হক খোকন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আট বছর ধরে তিনি যে কাজটি করছেন সেজন্য তার নাম পাঠাগার আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চাকরিকালীন অবসরে পাওয়া এককালীন টাকা স্ত্রী এবং পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদের লভ্যাংশ থেকে তিনি বছরের পর বছর ধরে নিজেকে ভালো কাজে জড়িয়ে রেখেছেন।
সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের বিভাগীয় সম্মেলনগুলোতেও তিনি উপস্থিত থাকেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত পাঠাগার সম্মেলনেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন। প্রত্যেকটি বইবিষয়ক আয়োজনে সঙ্গে করে বই নেন তিনি। উপহার হিসেবে দেন সম্মেলনে আসা পাঠাগারগুলোর প্রতিনিধিদের। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী এমদাদুল হক খোকন বলেন, ‘বাবার দেওয়া উপদেশ অনুযায়ী যাতে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারি এবং আমি যেন মানুষের কল্যাণে এই কাজগুলো করে যেতে পারি সেটাই সবচেয়ে বড় আশা।’
তারেক