শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন কাজিম উদ্দিন। শুরুতে সবজির আবাদ করলেও, খরচ বাড়ায় তিনি ফল চাষে ঝোঁক দেন। পরিকল্পনা করে বারোমাসি মাল্টা চাষ শুরু করেন, যার মাধ্যমে তিনি কম খরচে অধিক লাভের মুখ দেখেন। প্রথমে অল্প জমিতে মাল্টা চাষ শুরু করলেও লাভ হওয়ায় বর্তমানে বিশাল বাগান গড়ে তুলেছেন। তার দেখাদেখি বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
কাজিম উদ্দিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাবুগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি ২০০৯ সালে ২০০ ভিয়েতনামি সবুজ মাল্টা বা বাউ-থ্রি মাল্টার চারা লাগিয়ে শুরু করেন। কিন্তু এখন তার বাগানে অন্তত ১০ বিঘা জমিতে মাল্টা রয়েছে। গত বছর ৫ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করলেও, এবার মাল্টার বাম্পার ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় তিনি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ টাকা ছাড়াবে বলে আশা করছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাগানের প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় সবুজ মাল্টা ঝুলে আছে। বেশির ভাগ গাছে এক থেকে দেড় মণ মাল্টা আসায় গাছগুলো নুয়ে পড়েছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে শ্রমিকরা মাল্টা তোলার কাজ করছেন এবং কাজিম উদ্দিন তাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। স্থানীয় লোকজন বাগান দেখতে আসায় বিনামূল্যে মাল্টা খেতে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে কেজি দরে মাল্টা কিনে নিচ্ছেন।
শ্রমিক সাইদুল মিয়া বলেন, ‘বাগান পরিচর্যা, গাছে খুঁটি দেওয়া, মাল্টা তোলা ও অন্যান্য কাজ করি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে সংসারের খরচ ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি।’
কাজিম উদ্দিনের জানান, ‘কাজিম উদ্দিন একজন কৃষিমনা মানুষ। বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফেরার পর সরাসরি বাগানে চলে যান। শ্রমিকদের সঙ্গে তিনি নিজেও বাগান পরিচর্যায় কাজ করেন। ফলে মাল্টার বাম্পার ফলন হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন তিনি। তার সফলতা দেখে স্থানীয় কৃষক ও বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকে মাল্টা বাগান গড়ে তুলেছেন।
কাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি কৃষি কাজ পছন্দ করি। প্রথমে সবজির আবাদ করলেও লাভবান হতে পারিনি। ফলের বাগান গড়ার ইচ্ছা ছিল। ২০০৯ সালে সাহস করে ২০০ ভিয়েতনামি সবুজ মাল্টা বা বাউ-থ্রি মাল্টার চারা লাগাই। প্রথম বছরেই লাভের মুখ দেখি। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় বেশি জমিতে চারা রোপণ করতে থাকি, ফলে লাভের পরিমাণও বাড়তে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে আমদানি করা বিদেশি মাল্টা ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমার বাগানে উৎপাদিত মাল্টা প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে ব্যাপকভাবে মাল্টা চাষ হলে আমদানি নির্ভরতা কমবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি ১০ হাজার টন কমেছে। গত অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন, যা কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয়েছে মাল্টা।
দেশে উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বাড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে, উল্লেখ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজিয়া তাবাসসুম। তিনি বলেন, ‘দেশের কৃষক ও বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষ করছেন। কিন্তু ওই তুলনায় উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বাড়ানো যাচ্ছে না। চাহিদা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে উৎপাদন বাড়বে ও আমদানি কমবে।’
ময়মনসিংহের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু জানান, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাল্টার আবাদ হয় ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট ও ত্রিশাল উপজেলায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর মাল্টার আবাদ বেড়েছে ৫০ হেক্টরের বেশি। এ বছর ৩৭৪ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে মাল্টার আবাদ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মাল্টার চাষ বাড়াতে চাষিদের পরামর্শসহ সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কারণ, উৎপাদন যত বাড়বে, আমদানি ততই কমবে।’