গণবিক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে সারা দেশে সহিংসতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে সেনাবাহিনী কেন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। পাশাপাশি দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাও সুস্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছেন তারা।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরে দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, শিল্পী ও শিল্প স্থাপনা ভাঙচুরের প্রতিবাদে বুধবার (৭ আগস্ট) বিকেলে ‘বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ’ ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন সংস্কৃতিকর্মীরা।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির মূল ফটকের বাইরে আয়োজিত প্রতিবাদী সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অভিনেত্রী কাজী রোকসানা রুমা। প্রতিবাদী সমাবেশে নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ, প্রাচ্যনাটের দল প্রধান ও নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম, অভিনেতা কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন, অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার, আলোক নির্দেশক ঠান্ডু রায়হান, অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকি, নির্মাতা রেদওয়ান রনি, অভিনেতা-নির্দেশক মোহাম্মদ বারী, সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা সাইফুল ইসলাম জার্নাল, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক মানোমী তানজানা অর্থিসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ৫টি প্রশ্ন উত্থাপন করেন কাজী রোকসানা রুমা। তিনি বলেন, ‘শিল্প, শিল্প স্থাপনা, ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা দিতে চরম অরাজকতার পরেও এখনো কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? এর পেছনে কোনো নীলনকশা থাকলে তা বানচাল করা হচ্ছে না কেন? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দিতে এবং চলমান সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে কোনো ধরনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না কেন? এমন পদক্ষেপ এখন কে নেবে- রাষ্ট্রপতি নাকি সেনাবাহিনী?’
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ কেন করা হচ্ছে-সেই প্রশ্নও তুলেন রুমা।
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান সফল করা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রমজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণি, সিভিল প্রশাসন এবং মিলিটারি প্রশাসনের সমন্বিত আলাপ ও আলোচনা শুরু না করে বঙ্গভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করার মাধ্যমে জনগণকে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বাংলাদেশ বর্তমানে কার শাসনে, কোনো বিধি অনুসারে চলছে? সেনাপ্রধানের নাকি রাষ্ট্রপতির অধীনে? ছাত্ররা অসহযোগের ডাক দিয়েছে। তাহলে তাদের বাদ দিয়ে আইএসপিআর কোন ক্ষমতাবলে সবকিছু খোলার ডাক দিল?’
সরকারি স্থাপনায় নাশকতার ঘটনায় সেনাবাহিনী সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলো কেন সেই প্রশ্নও তুলেন রুমা। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর, ময়মনসিংহের শশীলজসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য ভাঙচুর, সংবাদমাধ্যমে হামলা, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, সম্পত্তি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার নিন্দা জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।
প্রাচ্যনাটের থিয়েটারকর্মী ও জলের গানের মূল সমন্বয়ক রাহুল আনন্দের বাড়ি এবং তার সব বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানান তারা। এ পর্যন্ত ৭টি থিয়েটার দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার খবর জানান রুমা। এ অবস্থায় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়ার পরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘোর আশঙ্কার কথা জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।
রুমা বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি সাবেক ক্ষমতাসীন দল মুখস্ত বুলির মতন যে ভয়ের জুজু দেখিয়ে ফিরত তা-ই যেন খুব পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়িত হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস আক্রমণ, ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্ম ভাঙচুর, থিয়েটার দলের ওপর আঘাত এবং জ্বালাও-পোড়াও চলছে নির্বিচারে। পরবর্তী সময়ে নির্বিঘ্নে শিল্পচর্চার পরিবেশের ব্যাঘাত ঘটবে কি না তার আশঙ্কা প্রকাশ করছি।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনী নাগরিকদের সুরক্ষায় এগিয়ে না এলে দেশের শিক্ষার্থীদের গণঅভ্যুত্থান নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। সাময়িক বিজয় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে না গিয়ে, একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুবিধাবাদী, মতলববাজ, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শক্তির কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আবার কুক্ষিগত হয়ে যেতে পারে।’
নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনুরোধ রেখে সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষে কাজী রোকসানা রুমা বলেন, ‘আমরা যে মুখস্ত জুজুর ভয়ে কাবু ছিলাম এতদিন সেই জুজু যেন আমাদের শিল্পী, শিল্প স্থাপনা, সংখ্যালঘু ভাইবোন এবং পরিবারগুলোকে ভীত, সন্ত্রস্ত্র এবং আস্থাহীন না করে তুলে তার আবেদন জানাচ্ছি সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে। অতি দ্রুত দেশের জনগণের সুরক্ষা এবং সহিংসতা বন্ধের জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমরা চাই অতি দ্রুত একটি সুস্থ, সভ্য, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশে চালু হবে। আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।’
জয়ন্ত সাহা/সালমান/