ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাধ্যমে যে বিজয় এসেছে, তা একটি গোষ্ঠী হাতিয়ে নিতে তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাম রাজনীতিবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সম্পদ দখল ও চাঁদাবাজির মতো গর্হিত তৎপরতার সঙ্গেও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছেন বলে জানা তারা। এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নাশকতামূলক সব অপতৎপরতা বন্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তারা।
বুধবার (৭ আগস্ট) শাহবাগে দেশের ৩১টি সংগঠনের মোর্চা ‘প্রতিরোধী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন’ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে। বিকেল সাড়ে ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সম্প্রীতি সমাবেশ শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের দেশের জাতীয় বীর আখ্যা দিয়ে তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সমাবেশ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টায়। সমাবেশে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার পাশাপাশি চলে প্রতিবাদী গান ও কবিতা পরিবেশনা।
সমাবেশ থেকে চলমান পরিস্থিতিতে দিকনির্দেশনামূলক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, ধর্মীয় ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ধ্বংস করার অপতৎপরতা চলছে। পট পরিবর্তনের নতুন পরিস্থিতির সুযোগে সম্পদ দখল ও চাঁদাবাজির মতো গর্হিত তৎপরতার সঙ্গেও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক হামলাসহ এসব অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে।’
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনী সব দায়-দায়িত্ব গ্রহণের পরেও কেন জানমাল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ধর্মীয় স্থাপনা অরক্ষিত ছিল ঘোষণাপত্রে সে প্রশ্ন উত্থাপন করেন অমিত রঞ্জন দে। তিনি বলেন, ‘এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোন বিবেচনা ও অধিকারবলে সেনাপ্রধান আন্দোলনকারী সংস্থা ও সংগঠনকে পাশ কাটিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলসহ কতিপয় দল ও ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় বসলেন? এই ঘটনাই কি দেশে নানা সাম্প্রদায়িক হামলার জ্বালানি সরবরাহ করেছে?’
সামরিক বাহিনী দায়িত্বে থাকার পর শেখ হাসিনা ও তার দোসররা দেশ থেকে কিভাবে পালালেন সে প্রশ্ন রেখে অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘সেনাপ্রধানসহ সামরিক বাহিনীর এসব আচরণ ও তৎপরতা দেশবাসীর মনে নানা সন্দেহ ও প্রশ্নের অবতারণা করেছে।’
সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, ‘স্বৈরাচারী হাসিনা আমাদের অতীত ও ভবিষ্যৎ সব কেড়ে নিয়েছিল। আমরা গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চাই। কিন্তু গণতন্ত্র আর ভোটের নামে আরেকবার স্বৈরাচারকে চাই না।’
বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের নেতা ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কোনোভাবেই এখন হানাহানি করা যাবে না। কোনো বিভাজন করা চলবে না। পুলিশ আমাদের সন্তান। তাদেরও মারা যাবে না।’
লেখক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘বিজয় উদযাপনে নয়, উদ্বিগ্ন হয়ে আমরা আজ জড়ো হয়েছি। অভ্যুত্থানের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকার গঠন হয়নি। অথচ ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়াই এখন অনেক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে চায়। এটিকে সমর্থন দেওয়া যাবে না।’
সিপিবি নেতা ও উদীচীর সহ-সভাপতি জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, ‘ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর পা দিয়ে অনেকেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খাপ ধরে আছেন। তারা জেনে রাখবেন, মানুষ রক্ত দেওয়া শিখে গেছে। ক্ষমতায় গিয়ে আবারও স্বৈরাচারী আচরণ করার খায়েশ বাদ দিতে হবে।’
বিবর্তনের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লাল্টুর সভাপতিত্বে আয়োজিত সম্প্রতি সমাবেশে এ ছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন শহিদ আসাদ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান মিলন, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন।
সমাবেশে সম্মিলিত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে শোনান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘শান্তির গান গেয়ে আমরা নতুন দিনের পথে পা বাড়াব’, ‘দুনিয়ার যত গরিবকে আজ জাগিয়ে দাও’, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমারই এই বসুন্ধরা’ গানগুলো। আবৃত্তি করেন তীরন্দাজ নাট্যদলের দলপ্রধান দীপক সুমন এবং স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কামরুজ্জামান ভূঁইয়া।
সমাবেশে অংশ নেওয়া প্রতিবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হলো: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বিবর্তন সাংস্কৃতিককেন্দ্র, গণসংস্কৃতিকেন্দ্র, সংহতি সংস্কৃতি সংসদ, সমাজ অনুশীলনকেন্দ্র, বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, রাজু বিতর্ক অঙ্গন, চায় সাংস্কৃতিককেন্দ্র, ভাগ্যকুল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিককেন্দ্র, সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণ, প্রগতি লেখক সংঘ, গণসংস্কৃতি পরিষদ স্বদেশ চিন্তা সংঘ, বাংলাদেশ থিয়েটার, তীরন্দাজ, রণেশ দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদ, এই বাংলায়, ঢাকা ড্রামা, বিজ্ঞান আন্দোল মঞ্চ, বিবর্তন নাট্যগোষ্ঠী, বাংলাদেশ মূকাভিনয় ফেডারেশন, ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন, থিয়েটার ৫২, সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজী সংঘ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ, শহিদ আসাদ পরিষদ, মাদল, বটতলা-এ পারফরমেন্স স্পেস, সমাজ সি ফোরাম, চারণ সংস্কৃতিককেন্দ্র।