শিল্পকলার নানা মাধ্যমে নিবেদিত কর্মীদের ভবিষ্যত চর্চার ক্ষেত্র মজবুত করা ও শিল্পের সনাতন ও যুগোপযোগী ধারার বিকাশে সংস্কৃতি কাউন্সিল গঠনের ডাক দিয়েছেন শিল্পীরা। পাশাপাশি ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজ তত্ত্বে বিভাজনকারী চিন্তা ও মতাদর্শ থেকে দেশকে সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত করতে ঐক্যমতেও পৌঁছেছেন চিত্রকলা, আলোকচিত্র, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র শিল্পীদের একাংশ।
শনিবার (১০ আগস্ট) রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘রাষ্ট্র সংস্কার, সংস্কৃতি সংস্কার’ শিরোনামে সমাবেশের আয়োজন করেন শিল্পীরা।
‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পী সমাজ’ এর ব্যানারে আয়োজিত এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন চিত্র সমালোচক মোস্তফা জামান, আলোকচিত্রী-শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ, কিউরেটর আমিরুল রাজিব, শিল্পী বিথী ঘোষ, শিল্পী অমল আকাশ, আরিফ বুলবুল।
সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন লেখক-শিল্পী অরূপ রাহী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘শিল্প-সংস্কৃতির নানা চর্চায় যুক্ত মানুষজন ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে নিজ নিজ চর্চা অব্যাহত রেখে ছাত্র-জনতার কাতারে সামিল হয়ে রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতি মেরামতে ভূমিকা রাখবার সময় এখন। দল-মত-ধর্মের নামে আধিপত্যবাদী কার্যকলাপ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি সংস্কার নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য জরুরি।’
পরে তিনি ৭টি বিষয়ে আলোকপাত করেন।
অরূপ রাহী বলেন, ‘গত ১৬ বছরের অনির্বাচিত সরকারের উত্তরাধিকার, ঔপনিবেশিক জাতি-পরিচয়বাদী প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি বা সংস্কৃতির বিপরীতে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে সদর্থক তৎপরতার সংস্কৃতির উদ্বোধন করতে হবে। চিন্তা ও মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’
সংবিধান, প্রতিনিধিত্ব, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ ব্যবস্থার গণতন্ত্র সহায়ক সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ জানিয়ে অরূপ রাহী বলেন, ‘ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজমের চিন্তা ও মতাদর্শ থেকে সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত করতে হবে। বিভাজন, বৈষম্যের রাষ্ট্র দর্শন থেকে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হবে।’
সাহিত্য- সংস্কৃতি বিকাশের সঙ্গে জড়িত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণের ইতি টেনে শিল্পীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন রাহী।
রাহী তার বক্তব্যে সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও শিল্পকর্ম বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার প্রত্যয় জানালে শিল্পীরা ঐক্যমত জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারা দেশে শহিদদের স্মরণে ‘ইনসাফের দেয়াল’ শিরোনামে একটি স্মারক গড়ার প্রস্তাবনা জানান রাহী; যাতে সব শহিদের নাম খোদাই করা থাকবে। এই শিল্পকর্মটি রাজধানীর পাশাপাশি অন্যান্য জেলায় স্থাপন করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
দেশের নানা স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ, শিল্পকলা একাডেমি, ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ জানান মোস্তফা জামান।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে এখনও যদি গণতান্ত্রিক চেতনা তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। আমরা চাই সম্প্রীতির বাংলাদেশ যেখানে বাংলাদেশি আর পাহাড়-সমতলে বসবাস করা সব জাতিসত্তার মানুষ একত্র হয়ে বসবাস করবে।’
মুনেফ ওয়াসিফ বলেন, ‘আমাদের ছাত্রদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি। এরই মধ্যে দেশে হত্যা, লুণ্ঠন, অপর ধর্মের বাড়ি-মন্দির আর মাজার ভাঙচুর করে বিপ্লব ধূলিস্যাৎ করে দিচ্ছে একটি পক্ষ। এই হামলা করে কার কী লাভ? কোন ধরণের ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইছেন আপনারা? এই সুযোগে ভারতে আমাদের বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে কেউ কেউ। আমরা সব ধরণের অনায্যতা ও হামলার বিরুদ্ধে।’
আমিরুল রাজিব বলেন, ‘লুট, হত্যাকাণ্ড কি আর সংবিধান পরিবর্তন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিয়ে ঠিক করা যাবে? মানুষের মনে শিল্পিত, নন্দিত ধারণা কি আমরা নতুন করে প্রতিস্থাপন করতে পারব? আমরা শিল্পীরা কি আবার নিরাপদ পরিসরে কাজ শুরু করতে পারব?’
পরে তিনি বলেন, ‘কোন সরকার আসবে আর কোন সরকার আসবে না, তা নিয়ে আমাদের শিল্পীদের মাথাব্যথা নেই। আমরা শিল্পীরা রাস্তায় থাকব। সমাজের অসঙ্গতি দেখলে আমরা প্রতিবাদ করব।’
জয়ন্ত সাহা/অমিয়/