
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক খাতে প্রভাবশালী মহলের নেতিবাচক প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন, জাতিসত্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে ‘অনভিপ্রেত কৌশলী প্রস্তাবনায়’ তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ৪৩তম বার্ষিক অধিবেশনের শেষ দিনের সমাপনী অনুষ্ঠানে ‘সম্মেলন ঘোষণা’য় এসব কথা বলা হয়। ঘোষণাটি পাঠ করেন শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা।
এর আগে সকাল ৯টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ৪৩তম বার্ষিক অধিবেশনের সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। বুলবুল ইসলামের নেতৃত্বে সারা দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সকাল ১০টায় ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মফিদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি সম্মেলনে আর্থিক প্রতিবেদন পেশ করেন কোষাধ্যক্ষ নাসেহুন আমীন। প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা। সারা দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন।
পরে বিকেলে সমাপনী অধিবেশনে মফিদুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, একুশে পদকে ভূষিত খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী (রনবী)। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জহিরুল হক খান। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন লাইসা আহমদ লিসা। রবীন্দ্রপদক ও গুণী সম্মাননা প্রদান করা হয় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে। প্রয়াত শিল্পীর পক্ষ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন সারোয়ার ই আলম। শুরুতেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সব হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ-সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান লাইসা আহমদ লিসা।
পরে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাত সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। তবে উল্লিখিত নেতিবাচক প্রবণতাগুলো প্রভাবশালী মহলের দ্বারা পরিপুষ্ট হওয়ার বিভিন্ন ইঙ্গিত লক্ষ করে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর লালন, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙচুর অশনিসংকেত বহন করে। এই শঙ্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত জাতীয় সংগীত পরিবর্তন, জাতিসত্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে অনভিপ্রেত কৌশলী প্রস্তাবনা।’
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার নির্বিঘ্ন পথযাত্রা নিশ্চিত করতে আহ্বান আসে সম্মেলন ঘোষণায়। লাইসা আহমদ বলেন, ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ বিশ্বাস করে, প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আয়োজন তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে, আপন সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জাতি পরিচয়ের প্রধান নির্ধারক। জাতীয় সংস্কৃতি স্বাভাবিক গতিতে চলমান থাকে, বহিস্থ উপাদান গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।’
সহিষ্ণু সমাজ গঠনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনকর্ম অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন লাইসা। তিনি বলেন, ‘আজ যখন স্বদেশে মতাদর্শগত কারণে বিভাজিত সমাজের সাংঘর্ষিক রূপ পরিলক্ষিত হয়, বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা জটিল হয়ে পড়ে, ফিলিস্তিনে শিশুহত্যা চলে, তখন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম আমাদের বিশ্বশান্তি এবং দেশে সহিষ্ণু উদার মানবিক সমাজ গড়তে অনুপ্রাণিত করে।’
পরে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন খন্দকার খায়রুজ্জামান কাইয়ুম, মনসুরা বেগম, মেজবাহুল আলম, সুমা রায়, প্রকৃতি রায় সাঁঝ, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, তাজমিনুর রহমান, রানা সিনহা, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সিরাজুস সালেকীন, শম্পা আচার্য, বুলবুল ইসলাম, এ টি এম জাহাঙ্গীর, লাইসা আহমদ লিসা, তানিয়া মান্নান, বিথী পাণ্ডে, ঝুমা খন্দকার, পূরবী দে সেমন্তী, মৃদুল চক্রবর্তী, নুরজাহান বেগম শ্যামলীনা, মহাদেব ঘোষ, দিবাকর বিশ্বাস, শিমু দে, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, আজিজুর রহমান তুহিন, শামা জয়নাব। লোকসংগীত পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার, শ্রীকৃষ্ণ গোপাল এবং সাগর বাউল। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন সিলেটের ‘নৃত্যশৈলী’।
এ ছাড়া একক নৃত্য পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী, সুইটি দাশ, তাথৈ।
মেহেদী/