বসন্তবিকেলে সব উচ্ছ্বাস থেমে গেছে, প্রাঙ্গণজুড়ে সব মুখ বিবর্ণ-পাণ্ডুর। বাঙালি পাঠকের বৃহৎ মিলনোৎসব অমর একুশে বইমেলার শেষ বেলায় গতকাল শুক্রবার বইপ্রেমীদের চোখে-মুখে ছিল বিষাদের ছাপ। গতকাল বেলা ১১টায় দুয়ার খোলে অমর একুশে বইমেলার। ছুটির দিনে দুপুর গড়াতেই বইমেলা লোকারণ্য হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে দেখা গেছে, বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ অনেকটাই ফাঁকা।
প্রকাশকরা জানান, রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় দেশজুড়ে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, তার ছাপ পড়েছিল অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণেও। অন্বেষার প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানীবাসী থমকে গেছেন। তারা শোকে স্তব্ধ। যারা বই কিনতে এসেছিলেন, তাদের সবার মুখে কেমন বিষাদ, কেমন এক আতঙ্ক দেখেছি। বইমেলার শেষভাগে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখার প্রত্যাশা করেছিলাম, তা নেই। অন্যপ্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘শনিবার বইমেলা শেষ হয়ে যাবে। আজ যে উচ্ছলতা প্রত্যাশা করেছিলাম তরুণ পাঠকদের, তা নেই। অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব পড়েছে বইমেলায়।’ অবসর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা তার মোবাইলে ধারণ করা এক ভিডিও দেখিয়ে বলেন, ‘শুক্রবার (গতকাল) বেলা ৩টা পর্যন্ত মেলায় তেমন কোনো দর্শক-পাঠক ছিলেন না। হাতে গোনা যারা এসেছেন, তারা অবশ্য কিছু বই কিনেছেন।’
অমর একুশে বইমেলা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও পরে প্রকাশকদের অনুরোধে বইমেলার সময় আরও দুই দিন বাড়িয়ে দেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বইমেলার শেষ দিন আজ শনিবার মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়, শেষ হবে রাত ৯টায়।
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের হিসাবে এ বছরের বইমেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ৮০০টির বেশি। প্রকাশকরা জানান, নতুন বইয়ের সংখ্যা আদতে আরও বেশি। নতুন-পুরোনো বইয়ের বিকিকিনির পাশাপাশি বইমেলায় পাঠক তার পছন্দের মানসম্মত বইটি খুঁজে পেলেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তর জানতে খবরের কাগজের প্রতিবেদক কথা বলেন বেশ কজন পাঠকের সঙ্গে। তাদের মধ্যে অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা বলেন, ‘মেলায় গুটিকয়েক প্রকাশনী মানসম্মত বই প্রকাশ করে। তাদের বুকলিস্ট দেখে বই কিনেছি বেশ কিছু। কিছু প্রকাশনীতে আমার প্রিয় লেখকদের বই রয়েছে। সেসব বই খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হয়েছে।’ একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক লতিফুল হক বলেন, ‘ছোট প্রকাশক হিসেবে যাদের অনেকে অবজ্ঞা করেন, সেসব প্রকাশনীতেও কিন্তু তরুণ লেখকদের ভালো মানের বই থাকে। তাদের বইয়ের প্রচার হয়তো একটু কম। তবে একটু খোঁজ করলে সেখানে বইগুলো পাওয়া যায়।’
বই বিক্রি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বইমেলার বাণিজ্যিক দিক নিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রকাশকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নালন্দার প্রকাশক রেদওয়ান রহমান জুয়েল বলেন, ‘গতবারের মেলার চেয়ে এবার বই বিক্রি ২০ শতাংশ কমে গেছে। শুক্রবার বই বিক্রির পরিমাণ একটু বেশি হওয়ার আশা করলেও তা হয়নি। পাঠক বইমেলা থেকে না, অনলাইন বুকশপে বই কিনতে এখন বেশি আগ্রহী।’ অনন্যার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক বলেন, ‘শুরুর দিকে বইমেলায় বিক্রির পরিমাণ বেশ ভালো থাকলেও শেষ দিকে এসে তা হঠাৎ কমে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারির পর আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, বই বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। তবে ব্যাপার হলো মানুষ তার আর্থিক সংকট সামলে যে বই কিনতে আলাদা অর্থ ব্যয় করবে, সেদিন নেই।’ অন্বেষার প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন, ‘অনুপমের মিলন নাথ, আকাশের আলমগীর শিকদার লোটন, কাকলীর এ কে নাছির আহমেদ সেলিম জানান, তাদের প্যাভিলিয়নে বই বিক্রি বেশ ভালো হয়েছে। নাছির আহমেদ সেলিম বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনীতে বই বিক্রির পরিমাণ ভালো হওয়ার কারণ হলো হুমায়ূন আহমেদ। তার রচনাবলির বিশাল সম্ভার রয়েছে আমাদের। এ ছাড়া আনিসুল হক, সুমন্ত আসলামের আলাদা পাঠক রয়েছে। তাদের বইয়ের চাহিদাও তুমুল ছিল।’
জার্নিম্যান বুকসের স্বত্বাধিকারী কবি তারিক সুজাত বলেন, বইমেলায় আগত দর্শক-পাঠক সংখ্যা কত, তা জানতে বাংলা একাডেমি একটি ডেটাবেজ করতে পারে। সেখানে আগতরা নাম নিবন্ধন করে আসবেন। নিবন্ধিতদের কাছে বইমেলায় আসা নতুন বইয়ের তথ্যগুলো জানিয়ে একটি ই-মেইল বার্তা পাঠানো যেতে পারে। মেলাকে গতানুগতিক ধারার বাইরে নিয়ে আসতে হবে। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের বইমেলায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে লেখক-প্রকাশক ও অনুবাদকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বাংলা ভাষার বইগুলো কীভাবে তারা অনুবাদ করবেন, সেই প্রক্রিয়া নিয়ে এখানে আলোচনা হতে পারে, কপিরাইট ইস্যু নিয়েও কথা হতে পারে।’ অনুপমের স্বত্বাধিকারী মিলন নাথ বলেন, ‘বইমেলার কাঠামোগত পরিবর্তন করা দরকার। আয়োজক হলো বাংলা একাডেমি, প্রকাশকরা হলেন অংশগ্রহণকারী। বইয়ের মান, সাহিত্যের বাজার এসব নিয়ে যদি কাজ করতেই হয়, তবে বাংলা একাডেমিকে একটি আলাদা বিভাগ খুলতে হবে। তারা শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক কাজগুলো করবে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস না, বইমেলা নিয়ে বছরজুড়েই কাজ করতে পারেন তারা।’
বিশ্বসাহিত্য ভবনের প্রকাশক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘বইমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, এবার ভালো বইয়ের পাঠকের সংখ্যা অনেক। মেলায় সিরিয়াস পাঠক বাড়ছে। তারা গল্প, কবিতা ছেড়ে সমকালীন সাহিত্য, সমালোচনা বা ইতিহাসের বইয়ের যে চাহিদার কথা আমাদের জানিয়ে গেলেন, সন্তানদের হাতে যেসব বই তুলে দিলেন, তাতে আমরা জানলাম যে সামনে আমাদের কী ধরনের বই প্রকাশ করতে হবে।’
মেলার নতুন বই
গতকাল বইমেলার নতুন বইয়ের স্টলে জমা পড়েছে ২১৯টি বই। কথাপ্রকাশ এনেছে আফসান চৌধুরীর ‘দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’, অন্যপ্রকাশ এনেছে ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর ‘উনিশ শ একাত্তর’; অবসর এনেছে ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হাসান হাফিজ, আলী রীয়াজ ও অন্যান্যর ‘স্কুলদিনের বই পড়া’; গণপ্রকাশ এনেছে পাভেল রহমানের ‘সেইসব দিনগুলি’; গ্রন্থিক এনেছে তোফায়েল আহমেদের ‘সংস্কার সংলাপ: সূচনা সূত্র’; সৌম্য প্রকাশনী এনেছে মেসবাহ কামালের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা’; নান্দিক এনেছে হায়াৎ মামুদের ‘সে এক ঘটনা বটে’ ও পবিত্র সরকারের ‘খেয়ালিমেরিক’।
আজ শনিবার বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সমাপনী অনুষ্ঠান হবে। শুভেচ্ছা ভাষণ দেবেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্যসচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হবে।