
গতকাল বইমেলার ত্রয়োদশ দিনে টিএসসির দিক দিয়ে বেরোচ্ছি। যে পথটা বেরোনোর সেই পথেই দেখি লোকজন উল্টো দিক দিয়ে ঢুকছে। তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। পাশের একটা বেঞ্চে দুজন পুলিশ বসে গল্প করছে। বেরোনোর পথ দিয়ে যে লোক ঢুকছে, সেটা তারা খেয়াল করছে না। এদের এ রকম বড় কোনো মেলার নিরাপত্তা রক্ষার অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হলো না। মেলার নিরাপত্তাব্যবস্থা যে কতটা ঢিলেঢালা, এ হলো তার একটা দিক। এ রকমই দেখা গেল মেলাজুড়ে।
শব্দশৈলী প্যাভিলিয়নের সামনে যখন একটা টেলিভিশনের অনুরোধে কথা বলব, তখন ১২-১৩ বছরের এক পথশিশু ফুলের মালা হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মেলায় যখন ঢুকি তখনো ফুলওয়ালি, শিশুদের খেলনার পসরা নিয়ে কেনাবেচা করা অনেক হকারকে দেখেছি। বাংলা একাডেমির ভেতরে আসলে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। গতকালই আমাদের পত্রিকায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেছিলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তারা ‘কনসার্ন’ রয়েছেন। কিন্তু গতকাল পুরো বইমেলায় তাদের উদ্বেগের বা তৎপরতার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা ভাব প্রথম থেকেই দেখেছি।
সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি একটা চত্বরে টয়লেটের দুর্গন্ধ নাকে আসায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওই চত্বরের পেছনেই একটা পাবলিক টয়লেট থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। সব মিলিয়ে মেলার পরিবেশ একেবারেই ভালো ছিল না। ময়লা-আবর্জনা ও ভাসমান হকারের সঙ্গে ধূমপায়ীদেরও দেখেছি। বাংলা একাডেমির এদিকে নজর আছে বলে মনে হলো না।
এই পরিবেশ নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বাংলা ভিশনের সাংবাদিক ও কবি মামুন খান। তিনি বললেন, ‘সাজসজ্জার দিক থেকে জৌলুশ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চারদিকে আবর্জনা, ময়লা এসব পীড়াদায়ক। মেলায় যে কেউ খুব সহজেই ঢুকছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থাটা খুবই ঢিলেঢালা। প্রকাশকদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে ঘাটতি দেখছি। আতঙ্ক, হুমকি, হামলা বইমেলার সঙ্গে যায় না।’ অন্যবার যেমন অনেক লেখক বইমেলায় আসতেন, তারাও আসছেন না বলে জানালেন তিনি।
পাঠক সমাবেশের কথা যদি বলি, তা নিয়েও আশাব্যঞ্জক কিছু বলার নেই। টিএসসির দিক থেকে ঢুকলে প্রথমেই একসারি যে প্যাভিলিয়নগুলো চোখে পড়ে, সেগুলো ঘিরে গতকাল ক্রেতা দেখিনি। প্রথমার প্যাভিলিয়নে দেখলাম ভেতরে একঝাঁক কর্মী। তাদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু প্যাভিলিয়ন ঘিরে একজন মাত্র ক্রেতা। পাশের অবসর, ইউপিএল ও মাওলা ব্রাদার্সে বরং বেশ কিছু ক্রেতা দেখা গেল। মেলাজুড়েই এই ছিল প্রথম প্রহরের চিত্র। ভেতরে কর্মী, কিন্তু ক্রেতা নেই।
সময় বাড়লে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানের প্যাভিলিয়নগুলোর মধ্যে বাতিঘরে দেখলাম ক্রেতাদের ভিড়। কিন্তু পাশের ইত্যাদিতে একজন ক্রেতাও নেই। অন্য প্যাভিলিয়নগুলোর প্রায় একই অবস্থা। বাতিঘরে ক্রেতাদের ভিড়ের অন্যতম কারণ তাদের প্যাভিলিয়নটিতে নান্দনিক রুচির ছাপ আছে। এবারের মেলায় যাদের প্যাভিলিয়ন বা স্টল দেখতে সুন্দর, সেখানেই ছবি শিকারিদের পাশাপাশি ক্রেতাসমাগম দেখেছি। গতকাল সাজুগুজু করা তরুণীদের পাশাপাশি ধর্মীয় বই যারা পছন্দ করেন, এমন অনেক টিনএজারেরও দেখা মিলেছে।
প্যাভিলিয়ন ও স্টলগুলোর মতো লিটল ম্যাগাজিনের চত্বরটি অবস্থা ছিল আরও করুণ। এত প্রাণহীন লিটল ম্যাগাজিন চত্বর এর আগে কখনো দেখিনি। প্রায় ৩০ শতাংশ স্টলে কারও দেখা মিলল না। চত্বরটির প্রবেশপথেই একজন প্রতিকৃতি আঁকিয়ে তার সরঞ্জাম নিয়ে দিব্যি বসে প্রতিকৃতি আঁকছেন আর বাণিজ্য করছেন। ঢুকেই আমি পুরো পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করলাম। বেশ কিছু স্টলে কেউ নেই। শূন্য টেবিল খাঁ খাঁ স্টল। এ রকমই কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনের স্টল হচ্ছে এবং, জলধী, এবং মানুষ, দ্রষ্টব্য, ল্যাম্পপোস্ট, প্রজন্ম, মেঘ, আন্দোলন, কিশোর পাতা, কবি, নবচিন্তা, সৃষ্টিসুখ, কাশবন, স্বপ্নলোক, সৃজনধারা, সাফল্য, সাহিত্য ব্যঞ্জন, শব্দের তাজমহল, যাকাত, ধূলিপথ, কবিতার রাজপথ, নোঙর, বৈঠা ইত্যাদি। চিত্রটি হতাশার। প্রতিবছর লিটল ম্যাগাজিনের চত্বরে সাহিত্য-সংস্কৃতি, লেখালেখি-লেখক ইত্যাদি নিয়ে যে মনমাতানো আড্ডা বসত, তার ছিটেফোঁটা এবার দেখা গেল না। এ থেকে একটা কথা বলা যায়, দেশ থেকে বোধহয় লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ উঠে যাচ্ছে। সেভাবে নতুন নতুন লেখককেও আমরা পাচ্ছি না। বইমেলায় অন্তত আলোচিত কোনো তরুণকে দেখা গেল না, যাকে ভবিষ্যতে লেখক হয়ে উঠবে বলে উল্লেখ করা যায়। সেই তুলনায় নারী লেখকদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এ রকমই একজন ছোটগল্পকারের সঙ্গে দেখা হলো শব্দশৈলীর প্যাভিলিয়নে- সোমা দেব। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। এই মেলায় ‘কমলা রঙের রোদ’ নামে তার ছোটগল্পের একটা বই বেরিয়েছে। এটি তার অষ্টম ছোটগল্পের বই। তিনিই বলেছিলেন, শুধুই ছোটগল্প লেখেন। নারীর বিষয়-আশয়ই তার গল্পের বিষয়। বইমেলার টানে প্রতিবছরই রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসেন তিনি।
আরেক নারী আইরিন নিয়াজী মান্না- একাধারে তিনি সাংবাদিক, লেখক ও সম্পাদক। তিনি একটা অনলাইন পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি কিশোর লেখা নামে চমৎকার একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ধ্রুব এষকে নিয়ে বইমেলায় বেরিয়েছে এর বিশেষ সংখ্যা। এবার তার ‘টুটুলের কাছে চিঠি’ নামে একটা ছড়ার এবং চীনের রূপকথা নামে অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সপ্তডিঙ্গা থেকে। আরেকটি গল্পের বই ‘রবিনের পাখিরা’ বেরোচ্ছে জিনিয়াস থেকে।