সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজ নিজ প্রাঙ্গণে কাওয়ালি গানের যেন জোয়ার বইতে শুরু করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মরণে ও আধিপত্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে এসব ‘কাওয়ালিসন্ধ্যা’ আয়োজিত হচ্ছে। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতি আয়োজনে যেন আরও প্রাণের সঞ্চার জোগাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এই ভাবধারার গানের আসর আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলেও কাওয়ালির নতুন এই জাগরণকে অনেক শিক্ষার্থীই সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলে অভিহিত করছেন। কাওয়ালির সুর কোন কোন ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেছে আর কোথায় কোথায় পৌঁছানোর অপেক্ষা এ সবকিছুর বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহমুদ শাকিল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বরাবরের মতোই জুলাই ও আগস্ট মাসের গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের স্মরণে কাওয়ালি আসর আয়োজনেও বেশ এগিয়ে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৩০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) জাঁকজমকপূর্ণ এই কাওয়ালি গানের আসর অনুষ্ঠিত হয়, যার আয়োজক হিসেবে ছিল ‘বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্য’। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চলে অনুষ্ঠান। আসরে মূলত দুটি ব্যান্ড দল ক্বাসীদা এবং সিলসিলা কাওয়ালি পরিবেশন করে অনুষ্ঠান জমিয়ে তোলেন। সেখানে বাংলা, হিন্দি, উর্দু ও আরবি কাওয়ালির পাশাপাশি অন্যান্য গান, কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে এখন থেকে সব ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা চলবে বলে মত প্রকাশ করেন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্যের নেতারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) গত ৪ সেপ্টেম্বর ‘দ্রোহের গান ও কাওয়ালি সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন আজাদী মঞ্চের উদ্যোগে এটি অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৪টায় চবির কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর একক কবিতা, গান, অভিনয় ও কাওয়ালির পরিবেশন চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। আসরে আজাদী মঞ্চের শিল্পীরা ছাড়াও কর্ণফুলী থিয়েটার, চট্টলা গানের দল ও অনুরণন সংগীত একাডেমি অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক মো. শাহাদাৎ হুসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিলে এ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিই। হলগুলো খোলা না থাকায় যদিও উপস্থিতি নিয়ে আমাদের ভয় ছিল কিন্তু দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় দেখে আমরা রীতিমতো অবাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত সুন্দর আয়োজন, এত উপস্থিতি, গাঁজা, সিগারেটের ধোঁয়া কিংবা ইভটিজিং, হাতাহাতি ছাড়া এত বড় আয়োজন এই প্রথম হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। প্রশংসাগুলো আমাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছে। আজাদী মঞ্চ দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঞ্চ হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা আমাদের।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হয়ে গেল বিপ্লবী গান, আবৃত্তি ও কাওয়ালি গানের আসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী সাংস্কৃতিক মঞ্চের উদ্যোগে ‘মেহফিল-ই ইনকিলাব’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানটি গত ৬ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের সেলিম আল-দীন মুক্তমঞ্চে আয়োজিত হয়। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষ হয় রাত ১০টায়। আসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ‘ওয়ান এম্পায়ার’ ব্যান্ডের কাওয়ালির সুরের মূর্ছনায় দর্শকরাও মেতে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও সাভারের আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।
এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান, বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দর্শকসারিতে বসে আয়োজনটি উপভোগ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরপ্রবি) গত ৬ সেপ্টেম্বর কাওয়ালি গানের আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনকিলাব মঞ্চের আয়োজনে নবনির্মিত ইনকিলাব মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়। অতিথি হিসেবে সেখানে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. কামরুজ্জামান ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. ফাইকুজ্জামান মিয়া। আয়োজন নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য ওবায়দুল ইসলাম জানান, ‘আমরা এই আয়োজনের ব্যবস্থা করেছি মূলত গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের স্মরণের উদ্দেশ্যে এবং সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করতে। আমরা আশা করছি, আগামীতে যেকোনো আয়োজনে এভাবেই আপনাদের সহযোগিতা পাব।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ক্যাম্পাসে আয়োজিত কাওয়ালি আসরেও শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী সাংস্কৃতিক মঞ্চের উদ্যোগে ৮ সেপ্টেম্বর কাওয়ালি আসরের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে শুরু হওয়া আসরটি সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মিলমেলায় রূপ নেয়। এ ছাড়া স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকার স্থানীয়দের অংশগ্রহণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত মঞ্চ মুখরিত হয়ে ওঠে। কাওয়ালি সন্ধ্যার আয়োজন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী সাংস্কৃতিক মঞ্চের আহ্বায়ক হান্নান রহিম বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিরাত অনুষ্ঠান, কাওয়ালি অনুষ্ঠানের আয়োজন এত দিন বন্ধ ছিল। এর প্রতিবাদ হিসেবেই দেশব্যাপী আমরা কাওয়ালি আসরের আয়োজন দেখছি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এই আসরও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদেরই অংশ।’ আসরে পরিবেশনায় ছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাওয়ালি দল সঞ্চারী, শহরেরই দ্রোহের গানের একটি দল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আজাদী মঞ্চ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে কাওয়ালির আসর আয়োজনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও (রাবি) শামিল হয়েছিল। গত ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে এই আসরের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের জন্য ঢাকা থেকে তারেক রহমান কাওয়াল ও ওস্তাদ জুলকারনাঈন কাওয়াল যোগদান করেন। এ দুজনের নেতৃত্বেই শিক্ষার্থীরা কাওয়ালি পরিবেশন করেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কাওয়ালির সুরের মূর্ছনা ছুঁয়ে গেল কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কেও। গণ-অভ্যুত্থানে নিহত শহিদদের স্মরণে এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আজাদী মঞ্চের উদ্যোগে ‘দ্রোহের গান ও কাওয়ালি সন্ধ্যা’ শীর্ষকে কাওয়ালির আসরের আয়োজন করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ডায়না চত্বর ও মেইন গেটের মধ্যবর্তী জায়গায় বিকেল সাড়ে ৫টায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে পরিবেশনায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাগ্রত মঞ্চের শিল্পীরা এবং ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক জোট। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে আসরের সূচনা করার পর কবিতা, বিদ্রোহী গান ও কাওয়ালি পরিবেশন করে আয়োজনকে মাতিয়ে তোলেন তারা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরাও নিজেদের ক্যাম্পাসে কাওয়ালি আসরের আয়োজন করে। গত বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত মঞ্চে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘জবিতে কাওয়ালি’ আসরের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি বিকেল সাড়ে ৫টায় শুরু হয়ে রাত ১০টায় শেষ হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কাওয়ালি ব্যান্ড নিমন্ত্রণ এবং সাওয়ারী আসরে গান পরিবেশন করে। আর ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে কাওয়ালি ব্যান্ড সিলসিলা ও প্রখ্যাত কাওয়ালি গায়ক নাদিম কাওয়ালও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলেছেন আয়োজনের দায়িত্বে থাকা অন্যতম আয়োজক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী তৌসিব মাহমুদ সোহান। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ২০২২ সালের দিকেও আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাওয়ালির আয়োজন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন নানাবিধ কারণে সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ সময়ে এসে হলেও এমন প্রোগ্রাম করতে পারার অনুভূতি আসলে আমার জন্য বর্ণনাতীত।’ ‘জবিতে কাওয়ালি’র আয়োজনে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আবরার হামীম বলেন, ‘আমাদের আয়োজনে অভাবনীয় সাড়া পড়েছে! সহপাঠী ও সিনিয়র-জুনিয়রদের কাছ থেকে পেয়েছি অন্যরকম সহযোগিতা। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও দিয়েছেন উৎসাহ! সবার প্রতিই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও বুধবার কাওয়ালি গানের আয়োজন করা হয়েছে। ‘দ্রোহের গান ও কাওয়ালিসন্ধ্যা’র ব্যানারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও উপস্থিত থাকবেন। এদিন কাওয়ালিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও বিদ্রোহী গানগুলোও পরিবেশন করবে। আসন্ন আয়োজনটি ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ প্রফুল্লতা লক্ষ করা গেছে।
কলি