‘প্রতিদিন রাত হলেই ভাবতে হয় আজকে রাতটা কোথায় কাটাব? কীভাবে কাটাব? পড়াশোনার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএসের প্রিপারেশনও নিচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছরের মধ্যেই স্নাতক শেষ করে ফেলতে পারব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে গত জুলাই এবং আগস্ট মিলিয়ে আমাদের দুবার হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। যার ফলে পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’
এভাবেই পড়াশোনা ও বাসস্থান নিয়ে নিজের অনিশ্চয়তার কথা জানাচ্ছিলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী। গত ২৬ আগস্ট ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হলের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরদিন খবরের কাগজে ‘ছাত্রলীগের দোসর’ চিহ্নিত করতে হল ছাড়া শিক্ষার্থীরা, শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে কীভাবে স্থানীয়দের দেওয়া আলটিমেটামের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে হয় তার বর্ণনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে এসব শিক্ষার্থীদের এক রকম যাযাবরের মতো জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উদ্বাস্তুর মতো বন্ধু অথবা সিনিয়রের মেসে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে শুধুমাত্র রাত্রি যাপনের জন্য। দেশের বন্যা পরিস্থিতি, দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত ভোগান্তি এবং টিউশন টিকিয়ে রাখার আশায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের সিলেটেই অবস্থান করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনির মাধ্যমে পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করি। সিলেট থেকে এখন বাসায় চলে গেলে টিউশনিগুলো চলে যাবে। সারা দিন টিউশনি শেষে রাতে কোথায় থাকব বা কী খাব এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই পরীক্ষা, কিন্তু ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় আমার মতো অনেকেই হয়তো শারীরিক দুর্বলতা বা মানসিক আশান্তিতে ভুগবে।’
ছাত্ররা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগেই সেমিস্টার ফাইনাল চলমান ছিল। অনেকের পরীক্ষার সময়সূচি দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন বিভাগ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলামাত্রই পরীক্ষা শুরু হবে। এ পরিস্থিতিতে একদিকে খাবারের সমস্যা অন্যদিকে থাকার জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে। হল থেকে বের করে দেওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ছাত্রদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের চারটি রুম খুলে দেওয়া হয়। দুই বেডের একেকটা রুমে ৬ থেকে ৭ জন করে থাকতে হচ্ছে। প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী থেকে অতিথি ভবনে ২০ থেকে ২৫ জনের জায়গা মিলেছে। অন্য শিক্ষার্থীরা যাযাবরের মতো বাস করছেন।
এদিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসনাতকে সদস্যসচিব করে আবাসিক হলগুলোর সিট বরাদ্দের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাজ সিট বরাদ্দের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রাথমিক এই নীতিমালা বাস্তবায়ন।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে হলের সিট বণ্টনের নীতিমালা প্রণয়ন করার বিষয়ে একমত হয়েছি। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়ার জন্য আমরা একটা ফরম দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা শিগগিরই একটা নীতিমালা প্রস্তাব করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হবে। আমরা আশা করছি ছাত্ররা ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।’
প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে শাবিপ্রবির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ আছে। গত ২৬ মে ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়া হয়। ছুটি শেষে ২৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা থাকলেও বন্যার কারণে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারপর শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের আন্দোলন, পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে এখনো বন্ধ আছে শাবিপ্রবির শিক্ষা কার্যক্রম।