পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ। ২০১৪ সালে স্থাপিত হলেও নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে কলেজটি ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে।
শুরু হয় ইন্টার্নশিপসহ স্নাতক পর্যায়ের পাঁচ বছর মেয়াদি এমবিবিএস শিক্ষাক্রম। অথচ এক দশক পার হলেও প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ক্যাম্পাস পায়নি। ভাড়া করা ক্যাম্পাসেই তাদের শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের আবাসন সংকটসহ শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব, লাইব্রেরির কর্মকাণ্ডে সবাইকে বেগ পেতে হচ্ছে। আগে প্রতিবছর ৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। এখন ৭৫ জন করে ভর্তি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সংকট কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশন হয়ে একনেকে পাস হলেই আলোর মুখ দেখবে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস। কাটবে নানা সংকটও।শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা অগ্রাধিকার বিবেচনায় প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদনে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটের পাঁচতলা ভবন ভাড়া করে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গত ১০ বছর ধরে চালানো হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। এতে বহুমুখী সংকটে আছেন ৮০ জন শিক্ষক আর পাঁচটি ব্যাচের ২৭৮ শিক্ষার্থীসহ ৩১ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক। বিশেষ করে পর্যাপ্ত টিউটোরিয়াল ও লেকচার ক্লাস, শিক্ষকদের বসার স্থান, ল্যাব, সরঞ্জাম, টেকনিশিয়ান ও লাইব্রেরি না থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন। ভাড়া করা পুরোনো বাড়িতে শিক্ষার্থীদের দুটি ছাত্রীনিবাস ও তিনটি ছাত্রাবাস থাকলেও অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক কোয়ার্টার নেই। নেই নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাও। এসব নানামুখী সংকটে প্রতিযোগিতামূলক ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
নবম ব্যাচের শিক্ষার্থী আফিফা আক্তার বলেন, ‘আমাদের ৫০ শিক্ষার্থীর জন্যই আগে সবকিছু পর্যাপ্ত ছিল না। এখন ৭৫ জন করে ভর্তি হওয়ায় সংকট আরও বেড়ে গেছে। আমাদের টেকনিশিয়ান নেই। যন্ত্রপাতি অনেক কম। এ কারণে অন্য মেডিকেলে যেভাবে শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিস করতে পারছেন বা ওই জিনিসটাতে ওরা নিজেদের স্কিল ডেভেলপ করেছেন, আমরা সেভাবে পারছি না।’
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অর্নব চাকমা বলেন, ‘আমাদের এখন ক্লাসরুমের জন্য অনেক সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লাগে। আমাদের কনফারেন্স রুমকে ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। যদি কোনো প্রোগ্রাম থাকে তাহলে আমাদের লাইব্রেরিতে বসে ক্লাস করতে হয়।’
সপ্তম ব্যাচের তানভীর হোসাইন বলেন, ‘প্রথমবর্ষে খুব একটা সমস্যা নেই। তবে দ্বিতীয় বর্ষের ক্ষেত্রে ফরেনসিক মেডিসিনের সাবজেক্টওয়াইজ কোনো টিচার নেই। তৃতীয় বর্ষের ক্ষেত্রে আমাদের ফার্মাকোলজির মাত্র একজন টিচার। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের সংকট রয়েছে। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত ডরমেটরি নেই। আমাদের কোনো অডিটোরিয়াম নেই।’
অষ্টম ব্যাচের তাসনিয়া আহমেদ ঋদিকা বলেন, ‘শিক্ষার্থী ৫০ জন থেকে ৭৫ হলেও লাইব্রেরিতে সিট বাড়ানো হয়নি। আমাদের প্রফেশনাল পরীক্ষার সময় সব ব্যাচকে একসঙ্গে পড়তে হয়। কিন্তু সেখানে জায়গা হয় না। পড়ার জন্যও উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায় না।’
জানা গেছে, অস্থায়ী ক্যাম্পাসের অদূরেই প্রায় ২৬ একর জমির অধিগ্রহণসহ মাস্টারপ্ল্যান ও ডিপিপি নিয়ে ২০১৭ সাল থেকেই স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও রাঙামাটি গণপূর্তের মধ্যে শুরু হয় চিঠি চালাচালি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভবন নির্মাণকাজ বিলম্ব হওয়ায় প্রথমবার ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। পাঁচ বছর আগের সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন না হওয়ায় চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ফের রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। তবে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, ঘেরাও আর অবস্থান কর্মসূচির পর গণপূর্তের সেই পুরোনো আশ্বাসের ফুলঝুরি নিয়েই ক্যাম্পাসে ফেরেন তারা।
নানামুখী এই সংকটের জন্য নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মিত না হওয়াকে দুষছেন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. প্রীতি প্রসূন বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘প্রথমত সমস্যা হচ্ছে ক্লাসরুম, দ্বিতীয় সমস্যা আমাদের শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই। ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল না থাকাতে এখন তাদের পুরোনো কয়েকটি ভবনে রাখতে হচ্ছে। শিক্ষকদেরও থাকার জন্য কোয়ার্টার নেই। এসব মিলিয়ে আসলে অনেক রকম সমস্যা।’
এর আগে ডিপিপি পাঠানো হলেও কিছু সংশোধনী থাকায় তা ফেরত পাঠায় প্রাক-প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি। ফলে নতুন করে মন্ত্রণালয়ে সংশোধিত চূড়ান্ত ডিপিপি পাঠানো হয়েছে বলে জানান রাঙামাটি গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মি চাকমা। তিনি বলেন, ‘রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজ স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। সেখান থেকে পরিকল্পনা কমিশন হয়ে একনেকে পাস হলেই আলোর মুখ দেখবে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস।