রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল লতিফ। দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাসের মধ্যেই তিনি নানা সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন। চলমান দায়িত্ব এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আরাফাত রহমান অভি
দেশের নতুন এক প্রেক্ষাপটে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুর দিকে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রায় এক মাস বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-শূন্য ছিল, তারও আগে থেকে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমাদের ক্যাম্পাসেও অস্থিরতা বিরাজ করছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন পক্ষ নানা দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করে, যার কিছু ছিল যৌক্তিক, কিছু নীতি-বহির্ভূত। যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের চেষ্টা করেছি, বাকিগুলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি।
দায়িত্ব নিয়ে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছিল, যা গতিশীল করাই ছিল প্রধান অগ্রাধিকার। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সবাই একাডেমিক কার্যক্রম, গবেষণা এবং প্রশাসনে ইতিবাচক পরিবর্তন চেয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কিছু সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, যার মধ্যে কিছু ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে, আর কিছু প্রক্রিয়াধীন।
এই পাঁচ মাসে আপনি কী কী পরিবর্তন আনলেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আগে ১১ শতাংশ আসন কোটার জন্য বরাদ্দ ছিল। যার মধ্যে ৩ শতাংশ ছিল পোষ্য কোটা। পোষ্য কোটা বাতিলসহ কোটায় সংস্কার আনা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩ শতাংশ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ১ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও উপজাতিদের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোটায় প্রার্থী না থাকলে আসন মেধাতালিকা থেকে পূরণ হবে। আমরা দুইটি ক্লাস টেস্টের পরিবর্তে একটি মিডটার্ম পরীক্ষা চালু করেছি। ব্যবহারিক খাতা লেখার সংস্কৃতি বাদ দেওয়া হয়েছে। সব হলে ও রিডিং রুমে হাইস্পিড ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছি। সব শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল পেয়েছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে সেমিস্টার ফাইনালের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, যা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকবে। শিক্ষার্থীদের দাবিতে, মুজিব পরিবারের নামে রাখা ভবন ও হলগুলোর নাম পরিবর্তন করে নিরপেক্ষ এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বস্তি গড়ে তুলে বহিরাগতদের ভাড়া দেওয়া হতো। এসব বস্তির ৮০ শতাংশ উচ্ছেদ করা হয়েছে, বাকিগুলোর উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতি দূর করতে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করছি। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন ও আবাসিক হলে শতভাগ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে র্যাগিং বন্ধ করা হয়েছে।
বিগত সময়ে নিয়োগ, পদোন্নতি অনিয়ম এবং ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতাকারী শিক্ষার্থীদের বিচারের জন্য তদন্ত চলমান। ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। সিন্ডিকেট অনুমোদনের পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে আপনার পরিকল্পনা কী?
বর্তমান জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে মাঠপর্যায়ের চাহিদা পূরণে প্রয়োগিক শিক্ষার গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিতরণ নিশ্চিত করা। এ জন্য গবেষণার মানোন্নয়নসহ পাঠ্যক্রমে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রির মান সমান রাখতে প্রয়োজনীয় কোর্স ও ক্রেডিট সংখ্যায় সামঞ্জস্য আনতে আমি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কৃষি একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞান, তাই স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টার্নশিপ চালুর উদ্যোগ নিচ্ছি। ইন্টার্নশিপ বাস্তবায়নে ইউজিসির সহায়তা প্রয়োজন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ভাতা নিশ্চিত করতে। এটি তরুণদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেবে। কৃষি স্নাতকদের শুধু চাকরির জন্য তৈরি করার ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউজিসির ‘এ-গ্রেড’ তালিকাভুক্ত হলেও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে অবস্থান নেই কেন?
কোনো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হলে প্রথমেই আবেদন করতে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিভিন্ন শর্ত পূরণ করলেও দুঃখজনকভাবে প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরে কোনো প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেয়নি। আমরা এ অবস্থার পরিবর্তনে পদক্ষেপ নিয়েছি এবং ইতোমধ্যে কিউএস ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিংয়ের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই আমরা ভালো অবস্থানে পৌঁছাব।
বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে নিতে আপনি কী উদ্যোগ নেবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে উন্নতির জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাড়াতে হবে শিল্প-একাডেমিয়া সংযোগ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক গবেষণায় অংশগ্রহণ, বিদেশি গবেষকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিসহ নিয়মিত ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। ইতোমধ্যে শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা বছরব্যাপী চলবে। এতে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত নিজেদের আপডেট রাখতে পারবেন। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন, পিএইচডি গবেষণা বৃদ্ধি, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি, যৌথ গবেষণা কর্মসূচিসহ আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার ও বিদেশি শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নেব। এসব বাস্তবায়িত হলে আমরা দ্রুতই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।
পূর্ব প্রশাসনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?
পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রম জরুরি। গত বছর আকস্মিক বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন। বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে ধানের চারা, সবজির বীজ, মুরগির বাচ্চা, সার, কীটনাশক বিতরণ করে। যেখানে প্রশাসন সহযোগিতায় করেছে। এ ছাড়া, ‘জুলাই স্মৃতিচারণ ও আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো সিরাত মাহফিল আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনও চলমান। প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে, যা চলমান থাকবে।
শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
শিক্ষার্থীরা কঠিন সময় পেরিয়েছে, বিপ্লবের সব উপাদান দেখেছে। এখন তাদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। তারা যেকোনো সমস্যা নিয়ে আমার দপ্তরে আসতে পারে, আমি সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করব। প্রশাসক নয়, আমি শিক্ষক হিসেবে তাদের পাশে থাকতে চাই। আমি চাই শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে একটি গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে। আমি চাই, যখন আমি চলে যাব, শিক্ষার্থীরা আমাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে।
/ তাসনিম তাজিন