
থালায় থরে থরে সাজানো গোল ও রঙিন ফুলাকৃতির জিনিস। দেখতে ফুলের মতো মনে হলেও সেগুলো আসলে ফুল নয়, বাহারি রকমের পিঠা। অপর পাশ থেকে কানে ভেসে আসছে মন মাতানো গ্রামবাংলার গানের সুর। ছিল নাগরদোলাসহ শিশু বিনোদনের বিভিন্ন উপকরণও, বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলিয়ানার উদ্যোগে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী শীতকে বরণ করে নেওয়ার জন্য শৈত্যোৎসব ও পিঠাপুলি মেলার কথা।
মাঠের চারপাশ ঘিরে বসেছে পিঠাপুলির দোকান। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা হরেক রকম পিঠার স্টল দিয়েছেন। ভোজনরসিক বাঙালির শীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আসে খেজুরের রস এবং পিঠা। আর পিঠার সঙ্গে যদি থাকে বাংলার ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান তাহলে তো আনন্দের ফোয়ারা ছুটতে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে এমনই চিত্র দেখা গেল।
শীতের আমেজে গরম পিঠার সঙ্গে হৃদয়ে উত্তেজনার বারুদ ছড়ানো গান- সবমিলিয়ে এক অন্যরকম আমেজ তৈরি হয়েছে ক্যাম্পাসে। অগ্রহায়ণের শেষ এবং পৌষের শুরুর সময়টায় শীতের আমেজ শুরু হয়। পিঠা সাধারণত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হলেও শহরে এর ছোঁয়া লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে পিঠার স্টল থেকে উপার্জনের পন্থাও খুঁজে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকার গ্রামবাংলায় যেসব পিঠাপুলির প্রচলন রয়েছে- সেগুলো নিয়ে স্টলগুলো সাজানো হয়েছে। স্টলে পাওয়া যাচ্ছে চিতই, দুধচিতই, দুধপুলি, পাটিসাপটা, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, তেল পিঠা, ঝাল পিঠাসহ প্রায় শতাধিক রকমের পিঠা।
এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উপভোগ করছে ভাপা পিঠা। মাঝখানে ঝোলাগুড় এবং নারকেল থাকায় খেতে মজা বেশি। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় দাম একটু বেশিই বলে মত শিক্ষার্থীদের। পিঠা খেতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আমীরুল মুমিনীন জানান, পিঠার দাম স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি মনে হচ্ছে। তবে অনেকদিন পর ক্যাম্পাসে একটা আনন্দের আমেজ বিরাজ করছে। পিঠা খেতে খেতে মন মাতানো গান শুনছি। এমন পরিবেশ ক্যাম্পাসে এর আগে পাইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ১১ জন শিক্ষার্থী মিলে শ্বশুরবাড়ি নামক পিঠার স্টল দিয়েছেন। এই স্টলে দুধের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, ক্ষীর পুলি, মোমোস, গোলাপ ফুল, মুগ পাক্কান ও আন্তাসাসহ প্রায় ১২ রকমের পিঠা রয়েছে। কথা হয় স্টলের এক দোকানি সানজিদার সঙ্গে।
তিনি জানান, ক্যাম্পাস ও আশপাশের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। সন্ধ্যার মধ্যেই সব পিঠা শেষ হয়ে গেছে। আর স্টলটা আমরা শখ করে দিয়েছি। তাই আনন্দটাও দ্বিগুণ হয়েছে। তবে দাম বৃদ্ধির অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানান, বর্তমানে পিঠার কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং পিঠার গুণগত মান ঠিক রাখতে নির্ভেজাল কাঁচামাল ব্যবহারের ফলে দামটা একটু বেশি হয়ে যায়, এটা আমরাও বুঝি। তবে আমরা চাই আমাদের সহপাঠীরা যেন নির্ভেজাল এবং পিঠার আসল স্বাদটা উপভোগ করতে পারে।
শুধু পিঠাপুলিই নয়, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। সেখানে থাকে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন পরিবেশনা। সঙ্গে ছিল কাওয়ালি সন্ধ্যাও। প্রথম দিনের গান পরিবেশনার জন্য ছিলেন বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের দল ‘বাহে’, ব্যান্ড অন্বেসর, মাইম, অর্ণব, লালন কন্যা মিম। দ্বিতীয় দিনের জন্য কারসা ফোক ব্যান্ড, গানপোকা ও কাউয়ালি সন্ধ্যা। তৃতীয় দিনে মঞ্চ মাতিয়েছেন ক্যাম্পাস বাউলিয়ানা, দীপ্ত অ্যান্ড দুর্জয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন।
জাতিগতভাবে বাঙালির খাদ্যতালিকায় পিঠার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য ইত্যাদির সূত্র ধরে জানা যায়, আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশাল উপমহাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পিঠা যে জনপ্রিয় খাবার, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠার জনপ্রিয়তাই সম্ভবত বেশি ছিল। সেই সময় থেকেই বাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠাপুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পিঠাপুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ। আমাদের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক প্রতিটি বাঙালির অন্তরে।
হাসান