এখন পর্যন্ত ২০২৪-এ সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে শুধু ছাত্র বা পুরুষরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন তা নয়। শুরু থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ছাত্রী কিংবা নারীরাও। তিনজন নারী সমন্বয়কের সঙ্গে আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মোহনা জাহ্নবী
মোসা. আয়শা আক্তার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর বেগম বদরুন্নেসা কলেজের সমন্বয়ক। তার কাছে জানতে চাইলাম আন্দোলনে অংশ নেওয়ার শুরুর গল্পটা। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে বৈষম্যহীন, মেধাভিত্তিক চাকরি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত জানান। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়। বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনা থেকে আমিও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। শুরুর দিকে কর্মসূচিগুলোয় এককভাবে অংশগ্রহণ করতাম। পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃহত্তর এবং একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার জন্য চেষ্টা করি। তাদের নিয়ে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।’
আন্দোলনে অংশ নিতে পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো বাবা-মা চান না তার সন্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বিপদের সম্মুখীন হোক, মার খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকুক কিংবা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ুক। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে যেখানে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্ন মত এবং জীবনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে কোনো পরিবার তার সন্তানকে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সমর্থন জানাবেন না। কিন্তু বিবেকবোধ এবং নৈতিক জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারিনি। ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়ে দুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। কিন্তু সেই খবরটি পরিবারকে জানানোর সাহস করতে পারিনি। কলেজ প্রশাসনের একদিনের নোটিশে হল ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। ঢাকায় বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় থেকে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি।’
নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যখন আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে থাকে তখন নানাবিধ কারণে হামলা হওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কম থাকে। আমি মনে করি, আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলন আরও বেশি তীব্র ও বেগবান হয়েছে এবং আমাদের ভাইরা আরও সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন।’
নতুন বাংলাদেশে তার প্রত্যাশা সম্পর্কে বলেন, ‘একজন নারী শিক্ষার্থী এবং এই আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি আগামীর বাংলাদেশ একটি বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হবে। যেখানে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর স্বাধীনভাবে কাজ করবে। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নামক ক্যানসার একটি সফল সার্জারির মাধ্যমে দূর করা হবে। শিক্ষার্থীরা একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং পড়াশোনা শেষে জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পাবে। বিশেষ করে নারীদের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে সেটিই প্রত্যাশা।’
শাহিনুর সুমি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর ইডেন কলেজের সমন্বয়ক। প্রথমে আন্দোলনে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘পুনরায় হাইকোর্ট ৩০ শতাংশ কোটা রাখার যে রিট করেছে এর বিরুদ্ধে আমরা শিক্ষার্থীরা ঐকমত্যে পৌঁছাই যে, এটা একটা অন্যায়, বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করতে হলে আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ যারা আছি সবাই একত্রে আন্দোলন শুরু করি।’
পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হইনি। দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেই আন্দোলনগুলো চলছিল সেই আন্দোলনের সঙ্গে আমি বহমান থাকার এবং সবসময় প্রতিবাদ করার কারণে পরিবার থেকেও সবাই জানত বাধা দেওয়াটা তাদের জন্য অনৈতিক হবে। তাই তারা বাধা না দিয়ে বরং সমর্থনই করেছেন।’
কেউ কেউ মনে করেন, আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেই প্রসঙ্গে শাহিনুর সুমি বলেন, ‘নারীকে কেবল নারী হিসেবে গণ্য না করে মানুষ হিসেবে গণ্য করা উচিত। নারীরা যদি এই আন্দোলনে না থাকত তাহলে আন্দোলনে যে ভাইরা ছিলেন তারা একা কিন্তু লড়াইটা করতে পারতেন না। যদি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি কিংবা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরি, তারামন বিবি ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছিলেন বলেই কিন্তু ৪৭ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল, ভারত স্বাধীন হয়েছিল। বেগম রোকেয়া নারী ও পুরুষকে একই যানের দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। একটা চাকা হচ্ছে পুরুষ আরেকটা চাকা নারী এবং পুরো গাড়ি হচ্ছে একটা রাষ্ট্র। একটা চাকা যদি ছোট আর অন্য চাকা বড় থাকে তাহলে গাড়িটি কিন্তু এক জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে থাকে। সামনের দিকে এগোয় না। তাই মানুষের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। নারীরা অনেক মার খেয়েও কিন্তু রাজপথে থেকে গেছেন। যত দিন গেছে ভাইদের পাশে এভাবে বোনরা ছিলেন বলেই আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়েছিল। পুরো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। ফলে আমরা আজকের বাংলাদেশ দেখতে পারছি।’
নতুন বাংলাদেশে তার প্রত্যাশা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটা তৈরি হোক। তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হোক। নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হোক। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হোক। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি। প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা তৈরি হোক। সরকারে জবাবদিহির সিস্টেম তৈরি হোক। সংবাদমাধ্যমগুলো যেন সত্য খবর তুলে ধরতে পারে তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। মেয়েরা যেন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে, কোনো মেয়ে যেন ধর্ষণের শিকার না হয়, সর্বোপরি একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আনিকা তাহসিনা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক। আন্দোলনে অংশগ্রহণের শুরুর গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুরুটা আসলে হয় হল থেকে। হলের অনেক মেয়ে শুরু থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নেন । আমি আন্দোলনে যোগ দিই জুলাই মাসের শুরুর দিকে। এর আগে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে বাসায় ছিলাম। যেদিন ঢাকায় আসি, সেদিন আমরা হলের টিভি রুমে একসঙ্গে বসে পোস্টার ও প্লাকার্ড বানাচ্ছিলাম, আন্দোলনটা কীভাবে চালিয়ে যেতে পারি, কীভাবে কর্মসূচি দিলে আমরা সফল হতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেদিন থেকেই হল ব্যানারে বিপুলসংখ্যক মেয়ে মিলে কোটা সংস্কার আন্দোলন করা শুরু করি। তবে জুন মাসে হাইকোর্টের রিটের ভিত্তিতে যখন আমাদের ডিপার্টমেন্ট, সিনিয়র এবং পরিচিত অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে রায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে, তখন থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি।’
পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে আনিকা বলেন, ‘আমার পরিবার জানত যে আমি আন্দোলনে আছি। বাসা থেকে বলে এসেছিলাম, আন্দোলনে আমার থাকা উচিত। আমি আন্দোলন করতেই ঢাকা যাচ্ছি। কিন্তু তারা এটা জানত না যে, আমি সমন্বয়ক হিসেবে কমিটিতে এনলিস্টেড হয়েছি। তারা জানত, আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবেই আন্দোলনে যাচ্ছি। ১৫ জুলাই যখন আমাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়, ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বা ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য হই, তখন পর্যন্ত পরিবারের সমর্থন পুরোপুরিই ছিল। একটা পর্যায়ে যখন সমন্বয়ক হওয়ার কারণে সরকারের ওপর মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হুঁশিয়ারি আসতে থাকে, তারা রাতে ঘুমাতে পারতেন না। কখন বাসায় পুলিশ আসবে, কখন ডিবির লোক এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে এই ধরনের ভয় ছিল। আমি বাসায় থাকতে পারতাম না। তবু তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আমাকে সাপোর্ট করার। কখনো বলেননি, আপস করতে, আন্দোলন থেকে সরে আসতে কিংবা কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে। আমার ছোট বোন আর ছোট মামা আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জুগিয়েছেন এ ব্যাপারে।’
আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সেই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম যে আলোড়ন, তা সৃষ্টি হয় নারী শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। শাহবাগ মোড়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি, হলের মিছিলগুলো, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে স্লোগানে মুখরিত উত্তাল নারীদের যদি দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন আন্দোলনে নারীরা কখনোই বাধা ছিল না। বরং আন্দোলনে নারীরা ছিল শক্তি। আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক হয়েছি বলেই আজ বিজয় আনতে পেরেছি। ১৫ জুলাই যখন ছাত্রলীগ বর্বরোচিত হামলা চালায় তখন আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নারীরা। প্রথম আঘাতের শিকারও হন নারীরা। নারীরা ভীতু হলে এত হামলা বা আঘাতের পরও পূর্ণ শক্তি দিয়ে তারা রাজপথে থাকতেন না। নারীদের অবদান প্রতিটি স্তরেই রয়েছে। যেই স্ত্রী তার স্বামীকে, যেই মা তার সন্তানকে আন্দোলনে যেতে উৎসাহ জুগিয়েছেন, সন্তানের আত্মত্যাগকে মেনে নিয়েছেন, যে নারী নিজেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, শহিদ হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। নারী কখনোই দুর্বলতার প্রতীক হতে পারে না। নারী হচ্ছে শক্তি। নারী গোষ্ঠীকে কোনো জাতি যদি ক্ষুদ্র হিসেবে দেখে, তারা কখনোই বিজয় লাভ করতে পারবে না।’
নতুন বাংলাদেশ নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া কোনো ধরনের চাপ বা দুর্নীতির শিকার হবে না, মুক্ত স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাবে। নারী সমন্বয়ক হিসেবে আলাদাভাবে বলব, নারীদের ওপর হওয়া সব নির্যাতন, ধর্ষণের যেন সুষ্ঠু বিচার হয় এবং নারীদের চলাফেরার নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি হোক।’
জাহ্নবী