ঢাকা ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

‘নারী কখনোই বাধা নয় বরং শক্তি’

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:৫৯ পিএম
আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৪, ০১:০১ পিএম
‘নারী কখনোই বাধা নয় বরং শক্তি’
মোসা. আয়শা আক্তার, শাহিনুর সুমি ও আনিকা তাহসিনা

এখন পর্যন্ত ২০২৪-এ সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে শুধু ছাত্র বা পুরুষরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন তা নয়। শুরু থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ছাত্রী কিংবা নারীরাও। তিনজন নারী সমন্বয়কের সঙ্গে আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মোহনা জাহ্নবী

মোসা. আয়শা আক্তার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর বেগম বদরুন্নেসা কলেজের সমন্বয়ক। তার কাছে জানতে চাইলাম আন্দোলনে অংশ নেওয়ার শুরুর গল্পটা। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে বৈষম্যহীন, মেধাভিত্তিক চাকরি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত জানান। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়। বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনা থেকে আমিও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। শুরুর দিকে কর্মসূচিগুলোয় এককভাবে অংশগ্রহণ করতাম। পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃহত্তর এবং একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার জন্য চেষ্টা করি। তাদের নিয়ে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।’

আন্দোলনে অংশ নিতে পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো বাবা-মা চান না তার সন্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বিপদের সম্মুখীন হোক, মার খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকুক কিংবা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ুক। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে যেখানে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্ন মত এবং জীবনের নিশ্চয়তা নেই সেখানে কোনো পরিবার তার সন্তানকে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সমর্থন জানাবেন না। কিন্তু বিবেকবোধ এবং নৈতিক জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারিনি। ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়ে দুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। কিন্তু সেই খবরটি পরিবারকে জানানোর সাহস করতে পারিনি। কলেজ প্রশাসনের একদিনের নোটিশে হল ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। ঢাকায় বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় থেকে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি।’

নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যখন আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে থাকে তখন নানাবিধ কারণে হামলা হওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কম থাকে। আমি মনে করি, আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলন আরও বেশি তীব্র ও বেগবান হয়েছে এবং আমাদের ভাইরা আরও সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন।’

নতুন বাংলাদেশে তার প্রত্যাশা সম্পর্কে বলেন, ‘একজন নারী শিক্ষার্থী এবং এই আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি আগামীর বাংলাদেশ একটি বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হবে। যেখানে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর স্বাধীনভাবে কাজ করবে। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নামক ক্যানসার একটি সফল সার্জারির মাধ্যমে দূর করা হবে। শিক্ষার্থীরা একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং পড়াশোনা শেষে জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পাবে। বিশেষ করে নারীদের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে সেটিই প্রত্যাশা।’

শাহিনুর সুমি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর ইডেন কলেজের সমন্বয়ক। প্রথমে আন্দোলনে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘পুনরায় হাইকোর্ট ৩০ শতাংশ কোটা রাখার যে রিট করেছে এর বিরুদ্ধে আমরা শিক্ষার্থীরা ঐকমত্যে পৌঁছাই যে, এটা একটা অন্যায়, বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করতে হলে আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ যারা আছি সবাই একত্রে আন্দোলন শুরু করি।’

পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হইনি। দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেই আন্দোলনগুলো চলছিল সেই আন্দোলনের সঙ্গে আমি বহমান থাকার এবং সবসময় প্রতিবাদ করার কারণে পরিবার থেকেও সবাই জানত বাধা দেওয়াটা তাদের জন্য অনৈতিক হবে। তাই তারা বাধা না দিয়ে বরং সমর্থনই করেছেন।’

কেউ কেউ মনে করেন, আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেই প্রসঙ্গে শাহিনুর সুমি বলেন, ‘নারীকে কেবল নারী হিসেবে গণ্য না করে মানুষ হিসেবে গণ্য করা উচিত। নারীরা যদি এই আন্দোলনে না থাকত তাহলে আন্দোলনে যে ভাইরা ছিলেন তারা একা কিন্তু লড়াইটা করতে পারতেন না। যদি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি কিংবা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরি, তারামন বিবি ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছিলেন বলেই কিন্তু ৪৭ সালে  বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল, ভারত স্বাধীন হয়েছিল। বেগম রোকেয়া নারী ও পুরুষকে একই যানের দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। একটা চাকা হচ্ছে পুরুষ আরেকটা চাকা নারী এবং পুরো গাড়ি হচ্ছে একটা রাষ্ট্র। একটা চাকা যদি ছোট আর অন্য চাকা বড় থাকে তাহলে গাড়িটি কিন্তু এক জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে থাকে। সামনের দিকে এগোয় না। তাই মানুষের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। নারীরা অনেক মার খেয়েও কিন্তু রাজপথে থেকে গেছেন। যত দিন গেছে ভাইদের পাশে এভাবে বোনরা ছিলেন বলেই আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়েছিল। পুরো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। ফলে আমরা আজকের বাংলাদেশ দেখতে পারছি।’

নতুন বাংলাদেশে তার প্রত্যাশা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটা তৈরি হোক। তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হোক। নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হোক। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হোক। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি। প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা তৈরি হোক। সরকারে জবাবদিহির সিস্টেম তৈরি হোক। সংবাদমাধ্যমগুলো যেন সত্য খবর তুলে ধরতে পারে তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। মেয়েরা যেন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে, কোনো মেয়ে যেন ধর্ষণের শিকার না হয়, সর্বোপরি একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

আনিকা তাহসিনা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক। আন্দোলনে অংশগ্রহণের শুরুর গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুরুটা আসলে হয় হল থেকে। হলের অনেক মেয়ে শুরু থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নেন । আমি আন্দোলনে যোগ দিই জুলাই মাসের শুরুর দিকে। এর আগে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে বাসায় ছিলাম। যেদিন ঢাকায় আসি, সেদিন আমরা হলের টিভি রুমে একসঙ্গে বসে পোস্টার ও প্লাকার্ড বানাচ্ছিলাম, আন্দোলনটা কীভাবে চালিয়ে যেতে পারি, কীভাবে কর্মসূচি দিলে আমরা সফল হতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেদিন থেকেই হল ব্যানারে বিপুলসংখ্যক মেয়ে মিলে কোটা সংস্কার আন্দোলন করা শুরু করি। তবে জুন মাসে হাইকোর্টের রিটের ভিত্তিতে যখন আমাদের ডিপার্টমেন্ট, সিনিয়র এবং পরিচিত অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে রায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে, তখন থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি।’

পারিবারিক সমর্থন প্রসঙ্গে আনিকা বলেন, ‘আমার পরিবার জানত যে আমি আন্দোলনে আছি। বাসা থেকে বলে এসেছিলাম, আন্দোলনে আমার থাকা উচিত। আমি আন্দোলন করতেই ঢাকা যাচ্ছি। কিন্তু তারা এটা জানত না যে, আমি সমন্বয়ক হিসেবে কমিটিতে এনলিস্টেড হয়েছি। তারা জানত, আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবেই আন্দোলনে যাচ্ছি। ১৫ জুলাই যখন আমাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়, ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বা ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য হই, তখন পর্যন্ত পরিবারের সমর্থন পুরোপুরিই ছিল। একটা পর্যায়ে যখন সমন্বয়ক হওয়ার কারণে সরকারের ওপর মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হুঁশিয়ারি আসতে থাকে, তারা রাতে ঘুমাতে পারতেন না। কখন বাসায় পুলিশ আসবে, কখন ডিবির লোক এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে এই ধরনের ভয় ছিল। আমি বাসায় থাকতে পারতাম না। তবু তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আমাকে সাপোর্ট করার। কখনো বলেননি, আপস করতে, আন্দোলন থেকে সরে আসতে কিংবা কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে। আমার ছোট বোন আর ছোট মামা আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জুগিয়েছেন এ ব্যাপারে।’

আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সেই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম যে আলোড়ন, তা সৃষ্টি হয় নারী শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। শাহবাগ মোড়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি, হলের মিছিলগুলো, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে স্লোগানে মুখরিত উত্তাল নারীদের যদি দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন আন্দোলনে নারীরা কখনোই বাধা ছিল না। বরং আন্দোলনে নারীরা ছিল শক্তি। আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক হয়েছি বলেই আজ বিজয় আনতে পেরেছি। ১৫ জুলাই যখন ছাত্রলীগ বর্বরোচিত হামলা চালায় তখন আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নারীরা। প্রথম আঘাতের শিকারও হন নারীরা। নারীরা ভীতু হলে এত হামলা বা আঘাতের পরও পূর্ণ শক্তি দিয়ে তারা রাজপথে থাকতেন না। নারীদের অবদান প্রতিটি স্তরেই রয়েছে। যেই স্ত্রী তার স্বামীকে, যেই মা তার সন্তানকে আন্দোলনে যেতে উৎসাহ জুগিয়েছেন, সন্তানের আত্মত্যাগকে মেনে নিয়েছেন, যে নারী নিজেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, শহিদ হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। নারী কখনোই দুর্বলতার প্রতীক হতে পারে না। নারী হচ্ছে শক্তি। নারী গোষ্ঠীকে কোনো জাতি যদি ক্ষুদ্র হিসেবে দেখে, তারা কখনোই বিজয় লাভ করতে পারবে না।’

নতুন বাংলাদেশ নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া কোনো ধরনের চাপ বা দুর্নীতির শিকার হবে না, মুক্ত স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাবে। নারী সমন্বয়ক হিসেবে আলাদাভাবে বলব, নারীদের ওপর হওয়া সব নির্যাতন, ধর্ষণের যেন সুষ্ঠু বিচার হয় এবং নারীদের চলাফেরার নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি হোক।’

জাহ্নবী

কন্যাসন্তান হোক পরম আকাঙ্ক্ষিত

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
কন্যাসন্তান হোক পরম আকাঙ্ক্ষিত
পুতুল সাজিয়া সুলতানা ও তার কন্যা গীতলীনা

একসময় আমাদের সমাজে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে সবাই মন খারাপ করত। জন্ম থেকেই কন্যাশিশুকে বোঝা মনে করা হতো। আমাদের সমাজকাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, মানুষ অবচেতন মনেই এমন ধারণা পোষণ করেন। তবে আশার কথা এটাই যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আধুনিক হচ্ছে এবং চিন্তাধারাও বদলাচ্ছে। তবে এখনো অনেকটা পথ বাকি। এ নিয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী

শরিফ মাহমুদ, তিন কন্যাসন্তানের বাবা। তার কাছে তৃতীয়বারের মতো কন্যাশিশুর বাবা হওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার তিনটি সন্তানই কন্যা হওয়ায় আমি খুব খুশি। যদিও তৃতীয়বারের মতো কন্যা হয়েছে জানলেই মানুষ করুণ মুখে সান্ত্বনা জানায় কিংবা জিজ্ঞেস করে আমি খুশি কি না, তবে আমার মনে হয় আমার ঘরে এখন তিনটা জান্নাত আছে এবং আমি সত্যিই মন থেকে খুব খুশি।’

সোহানা আক্তার, তার প্রথম সন্তান হয় কন্যা। প্রথম সন্তান কন্যা হওয়াতে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়িতে পুত্রসন্তানের সংখ্যা বেশি। তারা কন্যার অভাববোধ করতেন। তাই কন্যা হওয়াতে সবাই খুশিই হয়েছেন। এ ছাড়া আমার মায়ের বাড়িতে এমন পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে কন্যা ও পুত্র সন্তানের ভেতর কখনো বৈষম্য করতে দেখিনি। এজন্য আমার কন্যাশিশু জন্ম নেওয়াতে পারিবারিকভাবে কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। তবে কিছু লোক এই বলে সান্ত্বনা দিতেন যে, থাক, মন খারাপ করো না, পরেরবার তো ছেলেও হতে পারে। তাদের এসব সান্ত্বনাবাক্য আমার কাছে ভিত্তিহীন। কেননা, আমি নিজেও পুত্র ও কন্যা সন্তানের ভেতর বৈষম্য করতে শিখিনি।’

সমাজে যেমন কন্যাশিশুর জন্মকে কেন্দ্র করে ভালো অভিজ্ঞতা আছে, তেমনই আছে খারাপ অভিজ্ঞতাও। নিশাত তাসনীম নামের একজন জানান, তার প্রথম সন্তান কন্যা হওয়াতে শ্বশুরবাড়ির কেউ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারপরও প্রথমবারের মতো মেনে নেন। দ্বিতীয়বারও কন্যাসন্তান হলে সংসারে খুব অশান্তি শুরু হয়। এভাবেই চলছিল। পুত্রসন্তান কামনায় আবারও সন্তান নিলে কন্যাশিশু জন্মায়। তখন তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং বারবার কন্যাসন্তান হওয়ার জন্য তাকেই দোষারোপ করতে থাকেন।

কন্যাসন্তানকে এখনো আমরা পরিপূর্ণ মানুষ ভাবতে শিখিনি। কন্যাসন্তান আগে একদমই কাম্য ছিল না, আর এখন অনেকের কাছে সেটা হয়ে গেছে অপশনাল এবং শৌখিনতার বস্তু। কারও পুত্রসন্তান আছে, তার একটা কন্যা হলে মন্দ হয় না, না হলেও চলে। কিন্তু যার কন্যা আছে, সে তার জীবনকে যেন কোনোভাবেই পরিপূর্ণ ভাবতে পারেন না, পুত্রসন্তান তার লাগবেই। পুত্রসন্তানের আশায় অনেক বাবা-মা অধিকবার সন্তান নেয়। কিন্তু কন্যাসন্তানের আশায় কেউ বারবার সন্তান নিয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল।

কন্যাসন্তান হলে আমরা খুশি হই ঠিকই, তবে পুত্র আর কন্যার ভেতর বৈষম্য এখনো প্রকটভাবে করে থাকি। পুত্র সন্তানকে আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনভাবে বড় হতে সহযোগিতা করি, অন্যদিকে কন্যাসন্তানকে ছোটবেলা থেকেই একের পর এক সামাজিক বিধিনিষেধের দেয়ালে আটকে ফেলি। পুত্রদের শেখাই আকাশে ডানা মেলে উড়ো, আর কন্যাদের ডানা তৈরিই হতে দিই না, বরং তাদের মাথার ওপর কংক্রিটের সিলিং টেনে দিই, জানালা বন্ধ করে দিই এবং শেখাই- মেয়ে মানুষের আকাশ দেখতে হয় না, ঘরের চারটে দেয়ালই তাদের জীবন, সিলিংটাই আকাশ!

এখন মেয়েরা পড়াশোনা করছেন, চাকরি করছেন, তা দেখে মনে হতে পারে মেয়েরা এখন পুরোপুরি স্বাধীন, কোথাও কোনো বৈষম্য নেই। কিন্তু কন্যাসন্তান আকাঙ্ক্ষায় ও লালনপালনে এখনো রয়ে গেছে অনেক শুভংকরের ফাঁকি!

এই আধুনিক যুগে এসেও এসব কথা বেমানান কিংবা ভিত্তিহীন মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশে এখনো এটাই বাস্তবতা। পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু আরও জোরালোভাবে পরিবর্তন দরকার। সন্তানদের লালনপালনের ক্ষেত্রে কখনোই বৈষম্য করা ঠিক নয়। মুখে আমরা যতই সমতার কথা বলি, কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো রয়ে গেছে বৈষম্যের বীজ।

যতদিন পর্যন্ত আপনি আপনার কন্যাসন্তানকে পুরোপুরি মানুষের মতো বড় করে তুলবেন না, তাদের পেয়ে পরিপূর্ণ মনে করবেন না নিজেকে, ততদিন পর্যন্ত এ সমাজ পিছিয়েই থাকবে।

এ তো গেল কন্যাসন্তানকে যারা অপশন বা শৌখিন বস্তু হিসেবে দেখে, তাদের কথা। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেউ কেউ কন্যাসন্তান কোনোভাবেই কামনা করতে পারেন না। বাবাদের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক থাকে না, মায়েদের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক থাকে অনেক গভীর আর সুদৃঢ়। তারপরও অনেক নারী কন্যাসন্তানকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। এই অবিবেচক বোধ কেন তাদের গ্রাস করে, আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি?

আমাদের সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। এ সমাজে সবকিছু এমনভাবে পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত যে, সবাই মনে করে পুরুষরা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আর নারীরা বোঝা, তারা সমাজে কোনো অবদান রাখতে পারেন না, তাদের কাজ শুধুই সন্তান জন্ম দিয়ে লালনপালন করা আর পরিবার সামলানো। কন্যাসন্তানকে আজও সমাজে এমনভাবে পিষ্ট করা হয় সর্ব উপায়ে যে, মায়েরাও কন্যাসন্তানকে একটা আপদবালাই মনে করে। আর তাছাড়া কন্যাসন্তান হলে একজন মাকেও অনেক কটু কথা শুনতে হয়, অত্যাচারিত হতে হয়।

পত্রিকা কিংবা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিগত কিছু বছরের খবরের দিকে তাকালে একপ্রকার আঁতকে উঠতে হয়। জামালপুরে ২০২০ সালে এক মাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় শুধু কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে। একই বছর ভোলা জেলায় দুই বছরের কন্যাসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। গত বছর বরিশালে এক নবজাতক কন্যাসন্তানকে তার মা গলায় রশি দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক মা তার চার মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে পানিতে ফেলে মেরে ফেলেন। আবার লক্ষ্মীপুরে একজন বাবা তার এক বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে পিচঢালা রাস্তায় আছড়াতে আছড়াতে মেরে ফেলেন। সারা দেশে বিভিন্ন ক্লিনিকে, হাসপাতালে বছরজুড়ে অসংখ্য কন্যা ভ্রূণ হত্যা করা হয়। কোনো পুত্র ভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনা দুর্লভ।

আধুনিকায়নের এই যুগে এখনো অনেক নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত হন, যার খুব কম সংখ্যক ঘটনার কথাই পত্রিকায় আসে কিংবা মানুষ জানতে পারে। যতদিন সমাজে পুরুষতন্ত্র থাকবে, যতদিন নারীরা পুরুষতন্ত্র দ্বারা শোষিত হবে, ততদিন পর্যন্ত কন্যাসন্তান কখনো কাঙ্ক্ষিত হবে না, মানুষের মতো করে বাঁচতে পারবে না। এর জন্য সবার আগে এগিয়ে আসা দরকার নারীদের, মায়েদের। তারা যদি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে এই করুণ চিত্র কখনোই বদলাবে না। আর সমাজে কিছু পুরুষ রয়েছেন, যারা লিঙ্গ বৈষম্য করেন না, নারীদেরও স্বতন্ত্র মানুষ মনে করেন, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে সমাজ বদলাবে বলে আশা করা যায়।

জাহ্নবী

 

আট হাজার বৃক্ষের জননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০০ পিএম
আট হাজার বৃক্ষের জননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা
সালুমারাদা থিম্মাক্কা। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের এই পৃথিবীতে গাছের প্রয়োজন কতটা সেটা সবারই জানা। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনসহ বিশুদ্ধ বাতাস— সবকিছুর জন্যই আমরা গাছের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে একমাত্র গাছই। সেই গাছকে সন্তানরূপে মেনে নিয়ে ৮ হাজার গাছ লাগিয়েছিলেন ভারতের সালুমারাদা থিম্মাক্কা। সালুমারাদার জন্ম ১৯১১ সালের ৩০ জুন ভারতের কর্ণাটকে। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই কিন্তু তার কাজ তাকে এনে দিয়েছে অজস্র সম্মান। সালুমারাদা থিম্মাক্কা পেশায় ছিলেন দিনমজুর। বিয়ের অনেক দিন পার হলেও তার কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় গাছকেই সন্তান হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন সালুমারাদা। কিন্তু এটি তার আসল নাম নয়। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন আলা মারাদা থিম্মাক্কা। পরবর্তী সময়ে তার বৃক্ষপ্রীতি এবং বৃক্ষ নিয়ে তার নিরন্তর কাজের জন্য তাকে ‘সালুমারাদা’ নাম দেওয়া হয়। সালুমারাদা অর্থ ‘গাছের সারি’।

গাছ লাগানোর এই কার্যক্রম থিম্মাক্কা শুরু করেছিলেন গ্রাম থেকেই। থিম্মাক্কা এবং তার স্বামী দেখেছিলেন যে, তাদের গ্রামে অনেক বটগাছ থাকলেও পাশের এলাকায় প্রায় নেই বললেই চলে। তাই তারা ভাবলেন, তাদের পাশের এলাকায় কিছু বটগাছ লাগাবেন। ভাবনা অনুযায়ী কাজ শুরু করলেন থিম্মাক্কা দম্পতি। বটগাছ থেকে চারা কলম বানিয়ে লাগাতে শুরু করলেন তারা। প্রথম তিন বছরে প্রায় ৪০টি চারা রোপণ করেন তারা। তাদের সন্তানস্নেহে লালন করতে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল যেতেন এই দম্পতি। এমনকি চারা অবস্থায় গাছগুলোর যেন কোনো ক্ষতি না হয় কিংবা কোনো প্রাণী যেন খেয়ে না ফেলে সেজন্য বেড়াও দেন গাছগুলোর চারপাশে। কোনো সরকারি সাহায্য কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্যে নয় বরং নিজেদের সঞ্চয় দিয়েই ৩৮৪টি গাছের লালন-পালন করছিলেন থিম্মাক্কা।

১৯৯১ সালে স্বামী মারা গেলে থিম্মাক্কা একা হয়ে পড়েন। কিন্তু তখনো তার সঙ্গে ছিল তার গাছেরা। তাই দুঃখকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যোগে গাছ রোপণ, লালন-পালন, সেবা শুরু করলেন। বর্তমানে ৮ হাজার গাছের ‘মা’ এই সালুমারাদা থিম্মাক্কা। কিন্তু থিম্মাক্কার এই গাছেদের মা হওয়ার যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৯ সালে রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য তার রোপণ-লালন করা সন্তানসম ৩৮৪টি বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্ণাটক রাজ্য সরকার। কিন্তু থিম্মাক্কা প্রতিবাদ করলে এই সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হয়। এবং সেই গাছগুলোকে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। শতবর্ষ পেরোনো এই বৃদ্ধার কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে কর্ণাটক সরকারই গাছেদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছে এখন। ভারতের বর্তমান বোটানিক্যাল গার্ডেনের সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, থিমাক্কা দম্পতির রোপণ করা গাছেদের বাণিজ্যিক মূল্য প্রায় কয়েক কোটি টাকা। আর এই কয়েক কোটি টাকার বৃক্ষ বিক্রি করে তিনি নিজের সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারতেন। কিন্তু সেই ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখে স্বার্থহীনভাবে নির্দ্বিধায় তার রোপণ করা গাছগুলো তুলে দেন  সরকারের হাতে।

গাছ নিয়ে করা তার এই অসাধারণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননাও। ১৯৯৭ সালে তাকে সম্মানিত করা হয় ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র’ পদকে। পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য ‘জাতীয় নাগরিক’ সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ২০১৯ সালে পান ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান। লেখক ইন্দিরানা বেলুর থিম্মাক্কার একটি জীবনীগ্রন্থ লেখেন। যা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে ‘সালুমারাদা সর্দারনী’ নামে। ২০১৬ সালে বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় নাম ওঠে এই বৃদ্ধার। এরপর কর্ণাটক সরকার তার নামে ঘোষণা করেন ‘সালুমারাদা থিম্মাক্কা ছায়া পরিকল্পনা’ তহবিল। এই তহবিলের উদ্দেশ্য বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে মানুষকে প্রকৃতিসচেতন করে তোলা। বর্তমানে সালুমারাদার বয়স ১১৩ পেরিয়েছে। বয়সের ভারে শরীরের সঙ্গে সেভাবে না পেরে উঠলেও তার রয়েছে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। নিজের কাজ যাতে নির্বিঘ্নে এগোতে পারে, সেজন্য তৈরি করেছেন ‘সা লুমারাদা থিম্মাক্কা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’।

জাহ্নবী

আন্তর্জাতিক আদালতের প্রথম নারী বিচারক রোজালিন হিগিন্স

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:০০ পিএম
আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৯ এএম
আন্তর্জাতিক আদালতের প্রথম নারী বিচারক রোজালিন হিগিন্স
রোজালিন হিগিন্স। ছবি: সংগৃহীত

বিচারক হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। তাও আবার আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক হওয়া। সেই কঠিন জায়গায় যদি একজন নারী নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন, তা বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। আর প্রথমবারের মতো এই বিস্ময়কর কাজ যিনি করেছিলেন, তিনি রোজালিন হিগিন্স। আন্তর্জাতিক আদালতের প্রথম নারী বিচারক ছিলেন তিনি। তার পুরো নাম রোজালিন সি কোহেন। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২ জুন।

রোজালিনের শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ। তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গারটন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে নিউইয়র্কের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তার উচ্চশিক্ষা তাকে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে গভীর দক্ষতা প্রদান করে, যা তার পুরো কর্মজীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

আইনজীবী হিসেবে হিগিন্সের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। তিনি প্রথমে লন্ডনের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ছিলেন। এ সময় রোজালিন আন্তর্জাতিক সুরক্ষা, মানবাধিকার, শরণার্থী আইন এবং জাতিসংঘের কার্যক্রম নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেন। তার তাত্ত্বিক এবং গবেষণামূলক কাজগুলো তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন সম্মানিত আইন বিশেষজ্ঞ হতে সাহায্য করে।

১৯৯৩ সালে রোজালিন হিগিন্স ‘International Law and the Avoidance, Containment and Resolution of Disputes’ নামে একটি বই লিখেন; যেটি জাতিসংঘের শান্তি প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটি প্রধান রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত হয়। হিগিন্স সবসময়ই জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনকে সমর্থন করেছেন এবং তার কাজগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে হিগিন্সকে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এটি তার কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরামর্শমূলক মতামত দেওয়া। হিগিন্স তার বিচারিক কাজে যথাযথ সততা, নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। তার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আদালত জটিল মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘ সনদের বিভিন্ন ধারার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণী দক্ষতা ছিল অসাধারণ।

২০০৬ সালে রোজালিন হিগিন্স আন্তর্জাতিক আদালতের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি ২০০৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার সভাপতিত্বকালে তিনি মানবাধিকার, শরণার্থী সমস্যা এবং যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার করেন। তার নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালত বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যায় আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। হিগিন্সের কাজগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আইনানুগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রোজালিন হিগিন্সের বিচারিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার আন্তর্জাতিক আইনে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করা। তিনি শুধু আন্তর্জাতিক আইনের বিচারক হিসেবেই নয় বরং নারী হিসেবেও তিনি অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে তিনি একটি নতুন যুগের সূচনা করেন, যেখানে নারীরা বিচার ব্যবস্থার শীর্ষ পদ লাভ করতে পারে।

রোজালিন হিগিন্স তার অসাধারণ অবদানের জন্য বহু সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘ডেম’ উপাধি লাভ করেন এবং বহু সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পান। তার কাজের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। হিগিন্সের প্রকাশিত বই এবং প্রবন্ধগুলো আজও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে গবেষণা এবং অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৭ সালে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য ‘বালজান’ পুরস্কার লাভ করেন। তার দক্ষতা অনেক একাডেমিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। তিনি কমপক্ষে ১৩টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, ইয়েল ল স্কুল অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট এবং ম্যানলে ও হাডসন পদক পেয়েছেন।

জাহ্নবী

পর্যটন খাত হোক নারীবান্ধব

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৯ পিএম
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২২ পিএম
পর্যটন খাত হোক নারীবান্ধব
নারীরাও স্বাধীনতা নিয়ে আকাশ দেখুক। ছবি: সংগৃহীত

ভ্রমণ মানে শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরতে যাওয়া নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। ভ্রমণ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে শেখায়, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চমৎকার লেনদেনের সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার বাধার কারণে ভ্রমণ— বিশেষ করে একাকী কোথাও ঘুরে আসা একটি অপূরণীয় স্বপ্নের মতো। ভ্রমণে নারীদের নানাবিধ ব্যাপার নিয়ে লিখেছেন রাজিয়া সুলতানা

বাংলাদেশ বৈশ্বিক পর্যটনে একটি ক্রমবর্ধমান গন্তব্য হিসেবে অবস্থান করছে, এখন সময় এসেছে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার এবং ভ্রমণকে নারীদের জন্য আরও সহজলভ্য ও নিরাপদ করে তোলার। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্বতন্ত্রভাবে বেশকিছু শুধু নারীদের নিয়ে ট্যুর গ্রুপ তৈরি হয়েছে। পর্যটক ও লেখক এলিজা বিনতে এলাহীর সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশে নারীদের ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা, বাধা এবং করণীয় সম্পর্কে। তার মতে, ‘ভ্রমণ শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভ্রমণের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা হয় না। ভ্রমণ একটি শিল্প। ভ্রমণ যেমন ব্যক্তির জন্য দরকারি, তেমনি এটি রাষ্ট্রীয় পর্যটনশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয়। বিশ্বব্যাপী পর্যটন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, পর্যটনের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, পর্যটন অর্থনীতির চাকা সচল করার মাধ্যমে একটি গোটা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প অনেক অবহেলিত। নারীর স্বাবলম্বী হওয়া, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, নিজেকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভ্রমণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রমণ দেশের বাইরে হতে হবে এমন নয়, নিজের জেলা, নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতি জানার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ।’

এলিজা বিনতে এলাহী ঘুরেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলার আনাচে-কানাচে। তিনি মনে করেন, ‘দেশকে পর্যটনবান্ধব রাখা ও নারীবান্ধব করে তোলার জন্য নাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে। গণপরিবহনগুলো নারীবান্ধব নয়। আবাসনের সমস্যাও প্রকট।’ তিনি আরও জানান, ‘ভ্রমণের সঙ্গে পোশাকের একটা সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণবান্ধব পোশাকের ক্ষেত্রে নারীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন দরকার।’ 

নারীদের ভ্রমণে সাধারণত যেসব বাধা আসে তার মধ্যে রয়েছে-

সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং সামাজিক প্রত্যাশা
বাংলাদেশের কিছু নিয়মিত পর্যটন এলাকা যেমন- কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলার ফোকাসড কিছু লোকেশন, সিলেট ইত্যাদি ছাড়া বেশির ভাগ এলাকায় ভ্রমণে নারীদের জন্য রয়েছে নানাবিধ প্রতিকূলতা। কিছু কিছু স্থানে নারীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে অলিখিত বাধা। একজন নারী একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের বিষয়টি সন্দেহ, সংশয় বা সম্পূর্ণ অস্বীকৃতির সঙ্গে দেখা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে সমাজ প্রত্যাশা করে যে, নারীরা তাদের পরিবারের কাছে থাকবেন, ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ, অচেনা-অজানার অন্বেষণ অথবা কেবল অবসরের জন্য একাকী বাইরে বের হওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেবেন।

নিরাপত্তার উদ্বেগ
নারী পর্যটক জিনাত হাকিম নিরাপত্তাটাকেই সবার ওপরে রাখতে চান। তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে কোথাও যেতে ভ্রমণে একদমই ভাবতে হয় না। কিন্তু দেশের ভেতরে ভ্রমণে নিরাপত্তার কথাই সবার আগে ভাবতে হয়। আমাদের সমাজ মনে করে, একটি মেয়ে একা কেন ভ্রমণে যাবে- এই চিন্তাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধটা সমাজের আগে শুরু হয় পরিবারের সঙ্গে।’ বাংলাদেশে নারীদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে হয়রানির গল্প, নিরাপদ আবাসস্থলের স্বল্পতা, রাত্রিকালীন ভ্রমণ সংশয়, পাবলিক স্পেসে অনিরাপত্তা- ভ্রমণ পরিকল্পনায় নারীর জন্য এসবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। পরিবার থেকে নারী যে বাধা পায়, তা মূলত নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে তৈরি হয়। 

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
নারীর জন্য ভ্রমণকে সাধারণত একটি বিলাসিতা হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বিবেচনায় আর্থিক লেনদেন আছে, এমন সিদ্ধান্তের জন্য তাদের পরিবার বা স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি যেসব নারীর আর্থিক সংগতি বা সম্পদ রয়েছে, তারাও ভ্রমণের মতো ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে পারিবারিক চাহিদাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।

অবকাঠামোর অভাব
নারী পর্যটক আরিফা রহমানের কাছে নারীবান্ধব টয়লেটের অভাব এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের অপ্রাপ্যতাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়। বাংলাদেশের পর্যটন অবকাঠামো এখনো উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, বিশেষত নারীবান্ধব অবকাঠামোয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। নারীবান্ধব পরিষ্কার বিশ্রামাগার, নিরাপদ বাসস্থান, টয়লেট এবং নিরাপদ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মতো সুবিধার অভাব অনুভব করেন ভ্রমণপিপাসী নারী পর্যটকরা। অবকাঠামোর অপ্রতুলতা নারীদের ভ্রমণকে কঠিন করে তোলে- বিশেষ করে যারা একা ভ্রমণ করতে চান। ভ্রমণের সময় আরাম এবং নিরাপদ বোধ করা অনেক জরুরি। 

পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ
বাংলাদেশের অনেক নারীর জন্য পুরুষের সাহচর্য ছাড়া ভ্রমণকে অনুপযুক্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। ‘মানুষ কী বলবে’ তার ভয় একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা, বিশেষ করে রক্ষণশীল এলাকাগুলোয়। এমনকি বিবাহিত নারীরাও ভ্রমণের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। পারিবারিক দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি সামাজিক চাপ সবসময়ই থাকে। 

নারীদের ভ্রমণে উৎসাহী হওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

নারীর ক্ষমতায়ন এবং আস্থা তৈরিতে 
ভ্রমণ নারীদের চিরাচরিত কমফোর্ট জোনের বাইরে পা রাখার, নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এবং ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়। হোক সেটি একটি ভিনদেশি শহর, একটি নতুন ভাষা শেখা বা নিজের দেশের প্রকৃতিতে কেবল শান্তি খুঁজে পাওয়া, এই অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং ক্ষমতায়নে অবদান রাখে। অনেক নারীর জন্য, ভ্রমণ হলো তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক প্রত্যাশা থেকে মুক্ত হওয়ার একটি মাধ্যম।

সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন 
ভ্রমণ নারীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধারণা এবং জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে। ভ্রমণ আপনাকে আরও উন্মুক্ত মানসিকতা, সহনশীলতা এবং বোঝাপড়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি এমন একটি গুণ, যা ক্রমবর্ধমান বিশ্বে আপনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তিন পার্বত্য জেলার উপজাতীয় সম্প্রদায় থেকে কক্সবাজারের উপকূলীয় জীবন, হাওর কিংবা চা-বাগান, পাহাড় কিংবা সমুদ্র- আপনার ব্যক্তিগত জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।

মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতে
ভ্রমণ প্রাত্যহিক জীবনের ছকে বাঁধা রুটিন থেকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিরতি দেয়। প্রতিদিনের কাজ, পরিবার এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপ থেকে অব্যাহতি দেয়, যা নারীকে মানসিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করে। আরও আত্মবিশ্বাসী এবং উন্নত মানসিকতার করে তোলে এবং মনের পাশাপাশি শরীরও ভালো অনুভব করে।

অর্থনীতিতে অবদান
যত বেশি নারী পর্যটক ভ্রমণে যুক্ত হবেন, তত বেশি তারা স্থানীয় অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখতে পারবেন। ছোট ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং পর্যটনশিল্প আরও সমৃদ্ধি অর্জন করবে। নারীদের ভ্রমণে উৎসাহিত করা স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের অনুন্নত অঞ্চলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের পর্যটন খাত হওয়া চাই নারীবান্ধব 

পর্যটনকে নারীদের জন্য একটি কার্যকর ও আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে নারী ভ্রমণকারীদের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিরাপদ করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি 
সরকারের উচিত সব পর্যটক বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পর্যটন এলাকায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত রাখা, যেকোনো হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আবাসিক হোটেলগুলোয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, টয়লেট এবং খাবারের ব্যাপারে স্বাস্থ্যসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া ইত্যাদি জরুরি।

নারী পর্যটক জিনাত হাকিম মনে করেন, ‘নারীবান্ধব পর্যটনশিল্প নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ এবং কাজ করার অনেক জায়গা রয়েছে।’ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এত বাধা কিংবা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, নারীর ভালো থাকায় ভ্রমণও যুক্ত হোক। সব বাধা পেরিয়ে নারীর জন্য ভ্রমণ হোক নিরাপদ ও আনন্দের। উন্মুক্ত হোক প্রকৃতি ও সংস্কৃতির বদ্ধ দুয়ার।

জাহ্নবী

ভয়েস অব আমেরিকার দিলারা হাশেম

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০০ এএম
ভয়েস অব আমেরিকার দিলারা হাশেম
দিলারা হাশেম। ছবি: সংগৃহীত

আশির দশকে ভয়েস অব আমেরিকার এক অনবদ্য কণ্ঠ ছিলেন দিলারা হাশেম। যশোরের মেয়ে দিলারা হাশেম নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। নিয়মিত রাত ১০টায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রচারিত ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। আশির দশকে সংবাদ পাঠিকা দিলারা হাশেমকে চিনত না, এমন মানুষ কমই ছিল। স্পষ্ট উচ্চারণ, অপূর্ব বাচনভঙ্গি ও অসাধারণ কণ্ঠস্বর নিয়ে তিনি সংবাদ পড়তেন। বিশ্বসংবাদ মাধ্যমে বাংলা ভাষার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের অসাধারণ উৎস হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি।

দিলারা হাশেমের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৫ আগস্ট, যশোর জেলার মনিরামপুর থানাধীন মশ্বিমনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামে। কথাসাহিত্যিক দিলারা হাশেম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যোগ দেন তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানে। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন বাংলা খবর পাঠ করেছেন। পরে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনেও সংবাদ পাঠ করেছেন তিনি।

তার লেখার মূল উপজীব্য ছিল নগর জীবন ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশার গল্প। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। মধ্যবিত্ত সমাজে নাগরিক জীবনের সংগ্রামী এক নারীর সব বাধা আর ঘুরে দাঁড়ানোর জীবন আখ্যানকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাস তুমুল সাড়া ফেলেছিল পাঠকমহলে। ১৯৭৩ সালে তা চলচ্চিত্র হয়ে মুক্তি পায়। এমনকি উপন্যাসটি রুশ ও চীনা ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় তার নারীবাদী উপন্যাস ‘আমলকীর মৌ’। সেটিও পাঠকমহলে খুব সাড়া পায়। তার আরও কিছু উপন্যাস হলো- একদা এবং অনন্ত (১৯৭৫), স্তব্ধতার কানে কানে (১৯৭৭), বাদামী বিকেলের গল্প (১৯৮৩), কাকতালীয় (১৯৮৫), ম্যুরাল (১৯৮৬), শঙ্খ করাত (১৯৯৫), অনুক্ত পদাবলী (১৯৯৮), সদর অন্দর (১৯৯৮), সেতু (২০০০) এবং মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমূহ (২০১১)। তার কিছু গল্পগ্রন্থ হলো- হলদে পাখির কান্না (১৯৭০), সিন্ধু পারের উপাখ্যান (১৯৮৮) এবং নায়ক (১৯৮৯)। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগন্থ ‘ফেরারি’।

১৯৭২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন এবং ওয়াশিংটনে বসবাস ও কর্মজীবন শুরু করেন। বিবিসি বাংলা ও ভয়েস অব আমেরিকায় খণ্ডকালীন বেতার সম্প্রচারক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে পূর্ণকালীন মেয়াদে ভয়েস অব আমেরিকায় বেতার সম্প্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করেন দিলারা হাশেম এবং লেখালেখির চর্চাটাও চালিয়ে যেতে থাকেন।

ইতালি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়াসহ ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করেন দিলারা। এমনকি চীন, জাপান ও কমিউনিস্ট শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভ্রমণ করেন।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া শঙ্খচিল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), উত্তর শিকাগো ‘কালচারাল অ্যান্ড লিটারারি ইংক’ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), অলক্ত পুরস্কার (২০০৪ এবং) মুক্তধারা জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) এ-ও ভূষিত হন দিলারা হাশেম।

১৯৭৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করেন। অবসরে যান ২০১১ সালে। ২০২২ সালের ২০ মার্চ ৮৬ বছর বয়সে ওয়াশিংটনের নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রখ্যাত এই লেখক ও সুকণ্ঠী সংবাদ পাঠিকা দিলারা হাশেম।

জাহ্নবী