গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং এই সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কৃতিত্ব বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত নারীদের। গ্রামীণ কৃষি থেকে শুরু করে শহুরে শিল্প এবং অনানুষ্ঠানিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, নারীরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিতে অনস্বীকার্য শক্তি হয়ে উঠেছে। সামাজিক এবং কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তাদের অংশগ্রহণ পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় অর্থনীতিকে পরিবর্তন করেছে। আজকের এই লেখায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা, তাদের অবদান, তাদের চ্যালেঞ্জ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য লিঙ্গ-অন্তর্ভুক্তির গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে নারী: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালক
শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৩৬ শতাংশের ওপরে বেড়েছে। কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি), ক্ষুদ্র উদ্যোগ এমন নানাবিধ ক্ষেত্রে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের কাজ দারিদ্র্য হ্রাস, পরিবারের আয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে।
তৈরি পোশাকশিল্প
অর্থনীতিতে নারীদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) শিল্পে দেখা যায়, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। এই সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশ, যা এমন একটি শিল্পের বৃদ্ধিকে সচল রেখেছে, যেখানে বাংলাদেশ চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আরএমজি সেক্টর লাখ লাখ নারীকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা থেকে যারা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমান। এই নারীরা কেবল তাদের পরিবারকেই সাপোর্ট করেন না বরং উপার্জনের মাধ্যমে বৃহত্তর জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখেন।
আরএমজি সেক্টরের সাফল্যকে প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট শিল্পে নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে পারে তার একটি কেস স্টাডি হিসেবে দেখা হয়। এটি সামাজিক পরিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করেছে, লিঙ্গ সমতার উন্নতি ঘটিয়েছে, উন্নত কাজের পরিবেশ এবং উন্নত মজুরি দাবি করার জন্য নারীদের একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে।
কৃষিতে নারী
শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে রয়ে গেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং জিডিপি- উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখে। নারীরা এই সেক্টরে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন, বিশেষ করে জীবিকা নির্বাহ, ফসল উৎপাদন এবং পশুপালন ব্যবস্থাপনায়। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) তথ্য অনুসারে, কৃষি শ্রমশক্তিতে ৫০ শতাংশের বেশি। তারা প্রায়শই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা বেতন ছাড়াই বপন, ফসল কাটা এবং ফসল-পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণের মতো কাজে নিযুক্ত থাকেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিতে নারীদের অবদানকে স্বীকৃত ও আনুষ্ঠানিক করার লক্ষ্যে নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়ন গ্রামীণ উন্নয়নকেও উৎসাহিত করে, যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে।
উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্রঋণ
ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পগুলো নারীদের নিজস্ব ব্যবসা শুরু এবং ব্যবসার প্রসার এ মূলধনের জোগান দিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো লাখ লাখ নারীকে স্বাবলম্বী হতে, তাদের জীবিকা উন্নত করতে এবং সমাজের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম করেছে। নারী উদ্যোক্তারা এখন হস্তশিল্প ও টেইলারিং থেকে শুরু করে পোলট্রি ফার্মিং, পোশাক বিক্রি, প্রসাধনীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের খুচরা বিক্রেতার বিস্তৃত পরিসরে নিজেদের যুক্ত করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা যখন আয় নিয়ন্ত্রণ করে তখন তারা এমন ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেয়, যা পারিবারিক কল্যাণ বাড়ায়, ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে অর্থপূর্ণ প্রভাব তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে নারীর চ্যালেঞ্জ
যদিও নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখছেন, তবুও তারা সুযোগসুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। কিছু স্থায়ী বাধা হলো শ্রমজীবী নারীর মজুরি ব্যবধান, শিক্ষায় সীমিত প্রবেশাধিকার এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, যা নারীর গতিশীলতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে।
মজুরি বৈষম্য: বাংলাদেশের নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম উপার্জন করেন, এটি বিভিন্ন শিল্পে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, পুরুষদের তুলনায় নারীদের গড় মজুরি ২১ শতাংশ কম। এই মজুরি ব্যবধান নারীদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সীমিত এবং সামগ্রিকভাবে হ্রাস করে।
শিক্ষায় সীমিত প্রবেশাধিকার: যদিও বাংলাদেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও উচ্চশিক্ষায় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অনেক মেয়ে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক চাপ বা বাল্যবিবাহের কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব প্রকৌশল, প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রে উচ্চ বেতনের চাকরিতে নারীদের প্রবেশকে সীমাবদ্ধ করে।
সামাজিক মনোভাব: আমাদের সমাজ এখনো এটি বিশ্বাস করে যে নারীরা প্রাথমিকভাবে গৃহস্থালির কাজ এবং পরিবারের যত্ন নেওয়ার সব দায়িত্ব পালন করবে। কাজ এবং গৃহজীবনের ভারসাম্যের এই ‘দ্বৈত বোঝা’ নারীদের শ্রমশক্তিতে সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করার
ক্ষমতা হ্রাস করে, তাদের কর্মজীবনের অগ্রগতিকে সীমিত করে।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: এগিয়ে যাওয়ার পথ
অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অব্যাহত অবদান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে অবশ্যই কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করবে।
নীতিগত হস্তক্ষেপ: সরকারকে অবশ্যই জেন্ডার-সংবেদনশীল নীতিগুলোর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চালিয়ে যেতে হবে যা নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সমান কর্মসংস্থানের আরও ভালো সুযোগ প্রদান করবে। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করতে শ্রম আইন শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: নারীদের জন্য আর্থিক সুবিধাগুলোতে প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই সুবিধা তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য বড় পরিসরে ঋণ, বিমা এবং সঞ্চয়ের মতো বিকল্পগুলো প্রদানের দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাংকগুলো নারীদের ঋণদানে আরও সহজ শর্ত এবং আন্তরিকতা দেখাতে পারে।
শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন: নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (STEM) ক্ষেত্রে উচ্চ বেতনের চাকরির দরজা খুলে দিতে পারে। নারীদের প্রয়োজনের জন্য তৈরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো আইটি এবং ফিন্যান্সের মতো উদীয়মান সেক্টরে তাদের কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে।
সামাজিক নিয়মের পরিবর্তন: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সাংস্কৃতিক বাধাগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে, বিশেষ করে যা তাদের গতিশীলতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করে। সমাজভিত্তিক কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সবশেষে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদান অনস্বীকার্য এবং এ অবদান দিনে দিনে বাড়ছে। গার্মেন্টশ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা, কৃষক থেকে নীতিনির্ধারক, নারীরা সক্রিয়ভাবে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গঠন করছেন। যাই হোক, নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করার জন্য বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো ভেঙে আরও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ তৈরি করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নারীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ক্ষমতায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
জাহ্নবী