বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক বন্যা হয়েছে। বন্যার পানিতে ১০টিরও বেশি জেলা প্লাবিত হয়ে তীব্র মানবিক সংকট তৈরি করে। প্রবল বন্যায় হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়ে সাহায্যের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
বন্যার এই চরম অসহায় অবস্থা আর বিশৃঙ্খলার বিপরীতে bonna2024.xyz নামে একটি রিয়েল টাইম তথ্য কেন্দ্র নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চার শিক্ষার্থী ইফতেখার উচ্ছাস আহমেদ, তানজিমা হোসেন সীমা, মো. শাহ আব্দুল আজিজ, শানজিন সায়মা শারিতা। কথা হয় এই টিমের তরুণ নারী সদস্য শানজিন সায়মা শারিতার সঙ্গে।
শারিতার ভাষ্য, ‘আমাদের ১০ মিনিটের মধ্যে না বাঁচালে আমরা ডুবে মারা যাব। আমি আমার পরিবারের কোনো খবর পাচ্ছি না, কেউ খবর পেলে দয়া করে আমাকে জানান। এ আকুতি দুজন বন্যাদুর্গত ব্যক্তির। বন্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকজুড়ে মানুষের এমন আর্তনাদ ও সাহায্যের ডাক আমাদের বিচলিত করে। বন্ধু ইফতেখার উচ্ছাস আহমেদ চিন্তা করেন ফেসবুকের এই পোস্টগুলোকে কীভাবে আরও অর্গানাইজ করা যায়, বিভিন্ন জায়গার এত বিচ্ছিন্ন আর্তিকে যদি আমরা এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারি তাহলে রেসকিউ টিমগুলোকে সাহায্য করা যাবে। এমন চিন্তা থেকেই বন্ধু উচ্ছাস ২১ আগস্ট সকালে ওয়েবসাইটটি বানিয়ে ফেলে।’
শারিতাদের দলটি প্রথমে ফেসবুকের পোস্ট, ব্যক্তিগত যোগাযোগ, মোবাইল ফোনের তথ্য, ওয়েবসাইটের পাওয়া তথ্যগুলোকে ম্যানুয়ালি ইনপুট দিয়ে ডেটাবেইজ তৈরি করতে থাকেন। একটা সময় গিয়ে বন্যা ২০২৪ ওয়েবসাইটটি ভাইরাল হয় এবং আক্রান্ত মানুষ থেকে শুরু করে অন্যরাও ডেটা ইনপুট দিতে থাকেন। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত মোট ৮০ হাজার বন্যাকবলিত মানুষ ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিজেদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন।
শারিতা বলেন, ‘এই কাজটি করতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি পেয়েছি তা ছিল ত্রাণ বিতরণ এবং সাহায্য পৌঁছানোর অসমতা ও সমন্বয়ের অভাব। কোথাও আমরা খবর পেতাম ত্রাণ পৌঁছে গেছে, আবার কোথাও খবর পেতাম ৫-৬ দিন হয়ে গেছে কোনো খাবার সেখানে পৌঁছায়নি। এই দুইয়ের সমন্বয় কঠিন ছিল।’
ওয়েবসাইটটিতে চার সদস্যের এই টিম দিন-রাত পরিশ্রম করে একটি রিয়েল টাইম স্ট্যাটাস সচল রাখেন, যাতে করে বন্যাক্রান্ত মানুষ, রেসকিউ টিম এবং ত্রাণ বিতরণকারী দলগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করা যায়। দলের সদস্য তানজিমা হোসেন সীমার কাজ ছিল যেসব তথ্য পাওয়া যেত তার সত্যতা যাচাই করে তারপর ওয়েবসাইটে ইনপুট দেওয়া। সীমা বন্যার সময়গুলোয় ২৪ ঘণ্টাই ঘুম, খাওয়া বাদ দিয়ে তথ্য যাচাই, যোগাযোগ এবং ডেটা ইনপুট করে গেছেন। শানজিন সায়মা শারিতা সারাক্ষণ ডেটাগুলোকে চেক করে করে যেসব জায়গায় রেসকিউ হয়ে গেছে তা আপডেট করা, যেখানে সাহায্য দরকার সেখানে সমন্বয় করার মাধ্যমে ওয়েবসাইটের স্ট্যাটাসকে লাইভ এবং আপডেটেড রাখার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
সে সময়ের অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জকে মনে করে শারিতা বলেন, ‘একটা অদ্ভুত সময় ছিল, অনেক ভয় আর চাপ ছিল। আমরা এত তথ্য পাচ্ছিলাম, এত হাহাকার, মানুষ প্রতিনিয়ত সাহায্য চাচ্ছে। রিমোট এরিয়াতে সাহায্য পৌঁছানো একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ত্রাণ বিতরণে কিছু স্থানীয় সমস্যা ছিল। তথ্যের সত্যতা যাচাই করা এবং তা আপডেট রাখাটা অনেক সময়সাপেক্ষ ছিল। আমরা অনেক স্ট্রেসড ছিলাম, আমাদের সাহায্য করার ক্ষমতা অনেক কম ছিল, তবুও আমরা হাল ছাড়িনি। বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে গেছি।’
শানজিন সায়মা শারিতা সিলেটের মেয়ে। সিলেটে তার দাদাবাড়ি-নানাবাড়ির সবাই বন্যার কবলে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতেও শারিতা অন্যদের বাঁচানোর তাগিদে নিজেকে এই ওয়েবসাইটের সঙ্গে যুক্ত রেখে নিরন্তর কাজ করে যান।
এই টিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, তারা ‘ফিক্স বাংলাদেশ’ নামে একটি ওয়েবসাইট ডিজাইন করতে চান, যার কাজ শুরু হয়ে গেছে। শারিতারা বিশ্বাস করেন এই ওয়েবসাইটটি প্রাথমিকভাবে দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষকে সাহায্য করার পাশাপাশি যেকোনো জায়গায় অন্যায় ঘটলে কোথায় কীভাবে রিপোর্ট করতে হবে, অন্যায়ের প্রতিকার কীভাবে পাওয়া যাবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের সহযোগী হতে পারবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ওয়েবসাইটটি অধিক কার্যকর হবে বলে তারা আশাবাদী।
জাহ্নবী