বিশ্বের বিখ্যাত সব গোয়েন্দা উপন্যাস বা চলচ্চিত্র দেখে আমাদের মনে এই ধারণা তৈরি হয় যে, গোয়েন্দা মানেই পুরুষ চরিত্রের কেউ। নারী গোয়েন্দাদের কাহিনিও আছে কিছু কিছু, তবে তা সংখ্যায় খুব কম বলে আমাদের মানসপটে বৃহৎ আকারে ছাপ ফেলতে পারেনি। অর্থাৎ, এ কারণে গোয়েন্দা শব্দটা শুনলেই আমরা যত সহজে পুরুষের চরিত্র কল্পনা করতে পারি, তত সহজে নারীদের অবয়ব কল্পনা করতে পারি না। অথচ বিস্ময়কর কিছু নারী গোয়েন্দা ছিলেন পৃথিবীতে, যাদের কথা আমরা খুব কম মানুষই জানি। তাদের মধ্যে দুজন হচ্ছেন ন্যান্সি ওয়েক এবং মেলিটা নরউড। তাদের সম্পর্কে জানাচ্ছেন শামীমা নাসরিন
ন্যান্সি ওয়েক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্দান্ত ভূমিকা রাখা এই নারীকে বলা হয় ‘হোয়াইট মাউস’ বা সাদা ইঁদুর। খালি হাতে, গলায় জুডোর এক প্যাঁচ কষিয়ে তিনি মেরে ফেলেছিলেন এসএস-এর এক অফিসারকে! ১৯১২ সালে ওয়েলিংটনে জন্ম নেওয়া ন্যান্সি শৈশবেই পাড়ি জমান সিডনিতে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অবশ্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন নার্স হিসেবে। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ নেন সাংবাদিকতার ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে তিনি হার্স্ট পত্রিকার ইউরোপিয়ান প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার চোখের সামনে ঘটে নাৎসির বেশকিছু অমানবিক কার্যক্রম। এসব প্রত্যক্ষ করে ফরাসি দলে যোগ দেন তিনি। বার্তাবাহকের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। গেসটাপো সদস্যদের মুগ্ধ করে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য আদায় করে দিব্যি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন তিনি। এত দক্ষতার সঙ্গে পলায়নের জন্য তাকে উপাধি দেওয়া হয় ‘হোয়াইট মাউস’। ন্যান্সির মাথার বিনিময়ে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় পাঁচ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক! এর পর ন্যান্সি ফ্রান্স থেকে পালিয়ে স্পেন হয়ে ব্রিটেনে চলে আসেন। সামরিক জীবনে প্যারাস্যুটে করে বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে গিয়ে অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়া, সাবোটাজ করা প্রভৃতি কাজের জন্য তিনি ছিলেন ফ্রান্সের অন্যতম ভরসা। একবার এসএসের প্রহরীদের হাতে সদলবলে ধরা পড়েন তিনি। সেখানেই জুডোর আঘাতে এক অফিসারকে হত্যা করেন ন্যান্সি। এক অনবদ্য গুপ্তচর হিসেবে তার জীবন শেষ করেন ন্যান্সি। অবশ্য গুপ্তচরবৃত্তি তার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। গেসটাপোর হাতে ধরা পড়েন তার স্বামী হেনরি এডমন্ড ফিয়োকা, প্রচণ্ড অত্যাচার করে হেনরিকে খুন করে তারা। ২০১১ সালের ৭ আগস্ট ৯৯ বছর বয়সে মারা যান ন্যান্সি ওয়েক।
মেলিটা নরউড
১৯১২ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথে জন্মগ্রহণ করেন মেলিটা। ১৯৩০ সালে কেজিবিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্তব্যরত ছিলেন তিনি, তখন তার বয়স ৬০ বছর। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ হলেও মেলিটা সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে কাজ করতেন। ব্রিটিশ মেটাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে চাকরি করতেন তিনি, পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য রাশিয়ার কাছে পৌঁছে যেত তার মাধ্যমে। সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে। মেলিটার স্বামী, যার বাবা-মা দুজনই রাশিয়ান, তার এই গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে জানলেও মেনে নেয়নি। ১৯৯২ সালের স্নায়ুযুদ্ধে মেলিটার এই দ্বৈত ভূমিকা ধরা পড়ে যায় ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের কাছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অবশ্য তা সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশিত হয়নি। তাকে ডাকা হতো ‘গ্র্যানি স্পাই’ নামে। শেষ জীবনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে পেনশন পাঠানো হতো। ২০০৫ সালের ২ জুন যুক্তরাজ্যের উলভারহ্যাম্পটনে মৃত্যুবরণ করেন মেলিটা।
জাহ্নবী