সাম্প্রতিক সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ে নারীদের একটি নতুন ও সফল উদ্যোগের কথা উঠে আসছে। সেটি হলো পনির উৎপাদন। এটি একাধারে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি কোম্পানি পনির উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোম্পানিটির বিশেষত্ব হলো- এখানে মালিক থেকে শ্রমিক সবাই নারী। এমন উদ্যোগ বাংলাদেশে খুব কমই দেখা যায়, যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
২০১০ সালে নাগিনা নাজনিন বানুর জীবনে আসা এক আঘাতের কারণেই তৈরি হয় এই কোম্পানিটি। নাজনিনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই বছরেই স্বাচ্ছন্দ্যের চাকরি ছেড়ে অসুস্থ বাবার পনির প্রস্তুতের ব্যবসায় হাল ধরতে হয় তাকে। শুধু মোজারেল্লা পনির উৎপাদনের মাধ্যমে ‘এমিনেন্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের নাজনিনের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বছরেই ৯ লাখ টাকা আয় করে। নারী উদ্যোক্তারা তাদের নেতৃত্বগুণ এবং শ্রমের মাধ্যমে প্রমাণ করছেন যে, তারা শুধু পরিবারের দায়িত্ব পালনেই সীমাবদ্ধ নন বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
প্রথমদিকে এই উদ্যোগটি ছোট পরিসরে শুরু হলেও ধীরে ধীরে স্থানীয় নারীদের ব্যাপক উৎসাহ এবং প্রচেষ্টায় এটি বড় আকার ধারণ করে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দুধকে ব্যবহার করে এখানে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর পনির তৈরি করা হয়, যা জেলার বিভিন্ন বাজারে ও শহরাঞ্চলেও সরবরাহ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগটি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং বহু নারী এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।
প্রাথমিকভাবে, নারীদের এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নের পথে অনেক সামাজিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। গ্রামীণ সমাজে নারীদের কর্মজীবনে অংশগ্রহণকে বরাবরই একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই নারীরা আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম এবং সংহতির মাধ্যমে এসব বাধাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। কোম্পানির নারী উদ্যোক্তারা নিজেরাই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং বিপণন সবকিছু পরিচালনা করছেন। তাদের অনেকেরই আগে কোনোরকম ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা না থাকলেও বর্তমানে অত্যন্ত দক্ষভাবে এসব পরিচালনা করছেন। স্থানীয় এনজিও এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা পনির উৎপাদনের আধুনিক কৌশল রপ্ত করেছেন এবং স্বাস্থ্যবিধি ও মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এই উদ্যোগের মূল ভিত্তি হলো দুধ, যা স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দুধ সংগ্রহের পর তা পরিশোধন ও পরীক্ষা করে মান নিশ্চিত করা হয়। এর পর আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দুধকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম করা হয় এবং প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে পনির তৈরি করা হয়। প্রতিটি ধাপে নারীরাই কাজ করেন, দুধ সংগ্রহ, পনির তৈরি, প্যাকেজিং এবং বিপণন পর্যন্ত। এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা কুটিরশিল্পের মতো হলেও নারীদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। পনির উৎপাদনের সময় তারা স্বাস্থ্যবিধি ও মান নিয়ন্ত্রণের প্রতি খুবই যত্নবান থাকেন। উৎপাদিত পনির স্থানীয় বাজারে ভালো সাড়া পেয়েছে এবং চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এই পনির ঠাকুরগাঁও ছাড়াও দেশের অন্যান্য শহরেও সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে শহুরে এলাকায় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের মধ্যে এর চাহিদা অনেক বেশি। ঠাকুরগাঁওয়ের এই উদ্যোগটি নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার এক সফল উদাহরণ।
জাহ্নবী