১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু যে পুরুষরাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন, তা নয়। বরং অনেক নারীও সেই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। কিছুসংখ্যক নারী যুদ্ধ করেছিলেন অস্ত্র দিয়ে, কেউ শত্রুপক্ষের আস্তানায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে তা সরবরাহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, কেউ নিজের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, পরম স্নেহে তাদের পাতে তুলে দিয়েছেন খাবার, কেউ আবার অত্যাচার সহ্য করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে। কুষ্টিয়ার এমনই ছয়জন বীরকন্যা সম্পর্কে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
বীরকন্যা মজিরন নেছা
মজিরন নেছার আবাস কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নাতুড়িয়া গ্রামে। তিনি নিজ জেলাতেই যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে কখনো ধরেছেন ছদ্মবেশ, সংগ্রহ করেছেন শত্রুপক্ষের গোপন খবর। কখনো আবার সময়ের প্রয়োজনে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন হাতে। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছেন, সব আত্মত্যাগকে তখন সার্থক মনে হয়েছে। যুদ্ধের অনেক বছর পর বীরকন্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আরও সম্মানিত বোধ করেছেন বীরকন্যা মজিরন নেছা।
বীরকন্যা রাবেয়া খাতুন
রাবেয়া খাতুনের জন্ম কুষ্টিয়ার করিমপুরে। বর্তমানে তিনি সদর উপজেলার জিয়ারখী ইউনিয়নের বংশীতলা গ্রামে বসবাস করেন। যখন দেশজুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন তিনি নববধূ, বয়স মাত্র ১৬ বছর। ওইটুকু বয়সেই তাকে দেখতে হয়েছিল জীবনের সবচেয়ে নির্মম রূপ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে ভয়ানকভাবে নির্যাতন করেছিল। যখন যুদ্ধের তাণ্ডবে আর ভয়ে তার এলাকার সব নারী পালিয়ে গিয়েছিলেন, তার স্বামী তাকে যেতে দেননি। বলেছিলেন, ‘তুই চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্না করবে কে?’ আজ তার স্বামী নেই, স্বামীর ছোট্ট ভিটেতেই বসবাস করেন রাবেয়া। তার আফসোস, তার স্বামী আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, যদিও তিনি বীরকন্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক পরে।
বীরকন্যা মোছা. মোমেনা খাতুন
কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোমেনা খাতুন। ১৯৭০ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর, তখন তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আর তারপরের বছরেই তো দেশজুড়ে যুদ্ধ লেগে গেল। যুদ্ধের সময় মোমেনা খাতুন যখন মা-বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, তখন তাদের গ্রামে একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে। যে যার মতো জীবন নিয়ে পালাতে থাকে। তার ছোট বোনও পালিয়ে যান। কিন্তু তিনি থেকে যান তার মা-বাবার সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার মা-বাবাকে উঠানে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে বীরকন্যা নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বীরকন্যা মোছা. দোলজান নেছা
দোলজান নেছার জন্ম কুমারখালী উপজেলার এলঙ্গীপাড়া গ্রামে। দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তার কোলে তিন মাসের এক কন্যা। যেদিন তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে পাকিস্তানি সেনা আসে, সবাই রুদ্ধশ্বাসে পালাতে থাকে। কিন্তু তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি, তার আগেই পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। একপর্যায়ে তিনি বুদ্ধি করে দৌড়ে পালিয়ে যেতেও শুরু করেছিলেন, কিন্তু কোলে সন্তান থাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দৌড়ে পারেননি। তারা তাকে ধরে ফেলেছিল। সন্তানসহ মাটিতে ফেলে দিয়েছিল তাকে। তারা রাজাকারের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিল, তার স্বামীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের যোগাযোগ আছে। তাই স্বামীর সামনেই তাকে করেছিল পৈশাচিক ধর্ষণ। বেয়োনেট দিয়ে বাঁ স্তন খুঁচিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়েছিল। তার শাশুড়ি আর স্বামীকেও খুব মেরেছিল। এসব কথা সন্তানদের কাছে দীর্ঘজীবন গোপনই রেখেছিলেন দোলজান নেছা। পরবর্তী সময়ে তারা সব জানতে পেরেছেন।
বীরকন্যা মোছা. এলেজান (এলিজান নেছা)
কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর গ্রামের বাসিন্দা এলিজান নেছা। যুদ্ধের সময় তিনিও ছিলেন নববধূ। চোখে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু যুদ্ধের কবলে সব স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে গেল তার। এলিজান নেছার স্বামী পদ্মা নদীতে মাছ ধরতেন। তার নৌকাতে মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতেন, থাকতেনও। এমনকি তাদের বাড়িতেও আসতেন। সে খবর জেনে তাদের বাড়িতে ১৫-২০ জন পাকিস্তানি সেনা এসে হামলা করে। এলিজান নেছা এক বাড়িতে পালিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাকে সেখান থেকেই ধরে আনা হয় এবং অনেকে মিলে ধর্ষণ করে। এসব নিয়েই কষ্টেসৃষ্টে জীবন কেটে যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু ১৯৯২ সালে যখন তাকে গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিতে নিয়ে যাওয়া হলো, তারপর থেকে তাদের জীবন আরও বিভীষিকাময় হয়ে যায়। সমাজ তাদের কটু কথা শোনায়, বাঁকা চোখে দেখে, কাজের সুযোগ দেয় না। যারা দেশের জন্য এত ত্যাগ করল, তাদের জীবনেরই এমন করুণ পরিণতি।
বীরকন্যা মোছা. মাছুদা (মাসুদা খাতুন)
কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর গ্রামের আরও এক বীরকন্যার নাম মাসুদা খাতুন। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। বিয়ে হয়েছিল তারও প্রায় বছর দশেক আগে। তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। একাত্তরে একদিন তাদের বাড়িতে দুজন পাকিস্তানি সেনা আসে। তাকে জোর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে একজনের পর একজন ধর্ষণ করতে থাকে। বিছানায় তখন তার ছোট ছেলেকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা তার সেই ছোট্ট শিশুকে তুলে নিয়ে কাছের এক ডোবায় ফেলে দেয়। ধর্ষণের পর মাসুদা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন শরীরজুড়ে প্রচণ্ড ব্যথায় ঠিকমতো হাঁটতে পারেননি, খেতে পারেননি। অভাব-অনটনের জীবনে নিতে পারেননি চিকিৎসাও। পরবর্তী সময়ে শরীরের এই দুর্দশা তাকে বহুকাল বয়ে বেড়াতে হয়েছে। তার সঙ্গে এমন নোংরা ঘটনা ঘটে যাওয়াতে স্বামী তাকে প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারেননি। পরে মেনে নিয়েছেন আবার, অথবা মানিয়ে নিয়েছেন। রাজাকাররা লুট করেছে তাদের সোনাদানা, টাকা-পয়সার সামান্য সঞ্চয় যা ছিল। এমনকি দুটি গরু ছিল তাদের, সেসবও নিয়ে গেছে।
যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনেও তারা ভালো থাকতে পারেননি। তার সন্তানদের মানুষ ‘মিলিটারির ছাওয়াল’ বলে উপহাস করে। ১৯৯২ সালে গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলে আরও অনেক মানুষ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জানতে পারেন। ফলে জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন তাদের একঘরে করে রাখা হয়। তার ছেলেদের কাজ থেকে বের করে দেয় লোকজন। তাদের কেউ কাজ দেয় না। তাদের জীবনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার কথা তার সন্তানরা কেউ জানত না। কিন্তু গণ-আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তারাও জেনে গেছে। এই জানাটা তাদের কাছে ছিল অসম্মানের।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
বই: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়া গৌরবের ৫০ বছর
লেখক: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন এবং
ড. সারিয়া সুলতানা
জাহ্নবী