কোলাহলপূর্ণ শহরে যেখানে জীবন আধুনিকীকরণের দিকে এগিয়ে চলেছে, সেখানেও একটি চুপচাপ, শান্ত পৃথিবী রয়েছে। সেই পৃথিবীর নাম বৃদ্ধাশ্রম। যারা একসময় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের যত্ন নিতেন, তারাই অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। পরিবারের মানুষগুলোর স্মৃতিচারণ করে আর চোখের জল ফেলে এক একটা দিন পার করেন তারা।
বৃদ্ধাশ্রমের নীরব যাত্রা
পরিবারের জন্য নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উৎসর্গ করার পরও বৃদ্ধাশ্রম বাংলাদেশের অনেক নারীর শেষ আশ্রয় বা অবলম্বন হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যগতভাবে, এ দেশের সামাজিক কাঠামো বয়স্কদের পরিবারের কেন্দ্রে দেখতেই পছন্দ করে। এটি প্রত্যাশা করা হয় যে, পরিবারের সন্তানরা তাদের বৃদ্ধ পিতামাতার যত্ন নেবে। যাই হোক, সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন, অর্থনৈতিক চাপ এবং একক পরিবারের উত্থানের ফলে বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসকারী বয়স্ক নারীর সংখ্যা বাড়ছে।
পারিবারিক এই পরিবর্তনের কারণগুলো জটিল। কিছু নারী আর্থিক বোঝা বা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করেন; সন্তানদের তাদের যত্ন নেওয়ার মানসিক এবং আর্থিক চাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার আশায়। বিধবা জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নারীদের একা করে দেয়। পিতাহীন পরিবারে শিশুরা কাজের জন্য স্থানান্তরিত হয় বা বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্বাধীন জীবন গড়ে তোলে, যাদের বেশির ভাগই বিধবা মায়ের কাছে আর ফিরে আসে না।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য এজড অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (বিএএআইজিএম) দ্বারা পরিচালিত ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বৃদ্ধাশ্রমে প্রবেশকারী প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে এবং নারীরা এই জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। অনেকের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের এই যাত্রা পরিত্যাগের অনুভূতি, গ্রহণযোগ্যতার অভাব বা অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হওয়ার মতো মানসিক জটিলতায় ভরা।
বৃদ্ধাশ্রম জীবনের রুটিন
বৃদ্ধাশ্রমের ভেতরের জীবনে একটি ছন্দ আছে; যা রুটিনমাফিক। অর্থাৎ, দিনগুলো নির্দিষ্ট রুটিনের সঙ্গে চলতে থাকে। বাসিন্দারা একে অপরের সঙ্গে মিশে যান, খাবার ভাগ করে খান, একসঙ্গে প্রার্থনা করেন এবং মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যদের দেখা পান। যদিও এই নিয়মমাফিক পৃথিবীর বাইরে একাকীত্বের গভীর স্রোত বয়ে চলে।
রোকেয়া বেগমের (ছদ্মনাম) কথাই ধরা যাক, যিনি পাঁচ বছর ধরে ঢাকার একটি বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন। তিনি একজন বিধবা, দুই ছেলে বিদেশে কাজ করেন। রোকেয়া তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পর অনুভব করেন যে, তিনি আর একা নিজেকে সামলাতে পারবেন না, তাই চলে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি মৃদুস্বরে বলেন, ‘তারা মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি মিস করি তাদের ফোনকল’। রোকেয়ার মতো নারীদের জন্য এই আবেগগত দূরত্ব গভীরতম ক্ষত সৃষ্টি করে।
যে সমাজে পারিবারিক বন্ধন সবচেয়ে বেশি, সেখানে সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগের অভাব অনেক বয়স্ক নারীকে শূন্যতাবোধ দেয়। যোগাযোগের উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়- একটি ফোন কল, একবার দেখা, এমনকি একটি চিঠি যা তাদের বলে যে কেউ এখনো ভালোবাসে।
নিজেদের মধ্যেই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি
কষ্ট সত্ত্বেও আনন্দের মুহূর্তগুলো এখনো এই নারীদের জীবনকে উজ্জীবিত করে। অনেক বৃদ্ধাশ্রমে বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটে, একসঙ্গে বসবাসকারীরা পরিবারের বিকল্প হয়ে ওঠে। সমবয়সী নারীরা, যারা তাদের পারিবারিক জীবনে হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, তারা এখন নিজেদের গল্পগুলো একসঙ্গে ভাগ করে নেয়, একসঙ্গে হাসে, এমনকি একে অপরের তত্ত্বাবধায়ক হয়ে ওঠে।
চট্টগ্রামের একটি বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা ৮২ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন সেখানে তার বন্ধুত্বের কথা বলেন- ‘আমরা এখন বোনের মতো, আমরা একে অপরের দেখাশোনা করি। আমাদের মধ্যে একজন অসুস্থ হলে অন্যরা খাবার বা ওষুধ নিয়ে আসে। আমরা আমাদের জীবনকে ভাগ করে নিই, যেমনটা আমরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে করতাম’।
কয়েক দশক ধরে অন্যদের লালন-পালন করার পর (সন্তান, স্বামী এবং কখনো কখনো নাতি-নাতনি) তারা এখন সমবেদনা এবং সাহচর্যের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে একে অপরের ওপর নির্ভর করেন, যা তারা একদিন উদার হাতে পরিবারকে দিয়েছিলেন। এক অর্থে, বৃদ্ধাশ্রমগুলো একে অন্যের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে বেঁচে থাকার ছোট ছোট সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে নারীরা একে অপরের উপস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান।
স্বাস্থ্য এবং যত্ন: একটি ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ
যদিও মানসিক যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে নারীর শারীরিক স্বাস্থ্যও সমানভাবে চাপের বিষয়। তত্ত্বাবধায়কদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনেক বৃদ্ধাশ্রমে স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত। বাংলাদেশের অনেক বৃদ্ধাশ্রমই অনুদান বা সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, চিকিৎসা এবং মনোযোগের অভাব এখানে রয়েছে। বাত কিংবা ডায়াবেটিসের মতো বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন এমন নারীরা শুধু প্রাথমিক সেবাটাই পান।
বাংলাদেশ সরকারের প্রবীণ কল্যাণ আইন (২০১৩) প্রবীণদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে বৃদ্ধাশ্রমে বরাদ্দকৃত সম্পদ খুবই অপর্যাপ্ত। অনেক নারী হঠাৎ অসুস্থ হলে ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধের ওপরেই নির্ভর করেন। স্বাস্থ্যসেবার অভাব বয়স্ক নারীদের মধ্যে অবহেলার অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যাদের অনেকেই হয়তো গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে খামারের কাজ পর্যন্ত আজীবন শারীরিক শ্রম সহ্য করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার এবং হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর মতো এনজিওগুলো এসব বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প এবং মানসিক পরামর্শ প্রদানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এই নারীরা যাতে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন এবং তাদের প্রাপ্য চিকিৎসা সহায়তা পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য আরও টেকসই প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
তবুও স্বপ্ন
প্রাত্যহিক রুটিন এবং দীর্ঘ নীরবতার মধ্যেও বৃদ্ধাশ্রমের অনেক নারী এখনো তাদের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে আছেন। কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনের আশা করেন। কেউ কেউ মনে করেন মানুষ তাদের মনে করবে যে তারা এখনো এমন একটি বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ, যা মূলত তাদের ছাড়াই এগিয়ে গেছে।
শিরিন আক্তার, ৭৬ বছর বয়সী একজন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা, তার গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি আমার নাতি-নাতনিদের বড় হতে দেখতে চাই। আমি মাঝে মাঝে তাদের ছবি দেখি, হয়তো একদিন তারা আমাকে দেখতে আসবে’। শিরিনের মতো অনেক নারী এখনো স্বপ্ন দেখেন যে, একদিন তাদের সন্তানরা ফিরে আসবে বা তাদের জীবন নতুন বাঁক পাবে।
একটি আহ্বান
শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধনের ওপর নির্মিত একটি সমাজে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই নারীরা অতীতের ধ্বংসাবশেষ নয়, আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য- যারা যত্ন, সম্মান এবং সহানুভূতির সমান যোগ্য। সরকারি সহায়তার মাধ্যমে হোক বা সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই নারীরা যেন জীবনের শেষ সময়গুলো একাকীত্বে নয় বরং মর্যাদায় এবং প্রাপ্য ভালোবাসায় আবিষ্ট হয়ে যাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জাহ্নবী