আমাদের সমাজে সবসময় সন্তানসন্ততিসহ সুখী যুগল জীবন দেখা যায় না। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। এমন অনেক মা আছেন, যারা একাই সন্তানকে মানুষ করেন, একই সঙ্গে মা এবং বাবার ভূমিকা পালন করেন। আমরা তাদের ‘সিঙ্গেল মাদার’ বলি।
সিঙ্গেল মাদার হওয়ার কারণ
অনেক সময় স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক এত তিক্ত হয়ে যায় যে, মায়েরা সংসার ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। তখন একাই তাকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হয়। কখনো আবার স্বামী মারা গেলে মা আর দ্বিতীয় বিয়ে করেন না, সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দেন। কিছু কিছু নারী সন্তান দত্তক নিয়ে একাই লালনপালন করেন। এসব ক্ষেত্রে তারা সিঙ্গেল মাদারের ভূমিকা পালন করে থাকেন।
একা মাকে যেসব সমস্যা পোহাতে হয়
মায়েদের জার্নিটা বরাবরই কঠিন। আর একা মায়েদের জীবনযাত্রা আরও বেশি কঠিন। আমাদের সমাজে একা মায়েদের ভালো চোখে দেখা হয় না। সংসার ভাঙার জন্য মেয়েদেরই সাধারণত দায়ী করা হয়। সমাজ প্রত্যাশা করে, সাংসারিক জীবনে যত অশান্তিই হোক না কেন মেয়েরা সব মেনে নিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখবে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার যেই থিওরি প্রচলিত, তা যেন শুধু মেয়েদের জন্যই তৈরি। বেশির ভাগ মানুষ এও মনে করেন, একা মায়েদের চরিত্র ভালো হয় না। কিছু মানুষ মনে করেন, একা মায়েদের পুনরায় বিয়ে করা উচিত, নাহলে চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে। কিছু মানুষ ভাবেন, যে মা সন্তানের মঙ্গল কামনা করে সে কখনো দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে না। সমাজ সাধারণত একা মায়েদের ওপর সহনশীল হয় না। প্রতিনিয়ত তাদের স্রোতের প্রতিকূলে সমাজের অনেক কটু কথা শুনে টিকে থাকতে হয়।
আয়েশা রহমান (ছদ্মনাম) নামের একজন একা মা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার নেশা ও পেশা ছিল একজন লেখক হওয়া। নিয়মিত লেখালিখি করতাম, বই প্রকাশ করতাম। প্রেম করে বিয়ে করার পরও জীবন ভালোই চলছিল। একটা ছেলেসন্তান হলো আমাদের। তারপর ধীরে ধীরে সন্তানের বাবা বদলে যেতে লাগল। তবু সন্তানের কথা ভেবে মেনে নিলাম। দিনের পর দিন দেখতে থাকলাম, সংসার আর সন্তানের প্রতি সে উদাসীন হয়ে পড়ছে। সন্তানের দুধ থেকে শুরু করে কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসই সে কিনে দিত না। এদিকে একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি হলো আমার। নিজেই যতটা সম্ভব সব খরচ চালাতে থাকলাম। সন্তানকে নিয়ে কষ্ট করে চাকরি আর সংসার এ ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। খুব খারাপ লাগত, সন্তানের প্রতি তার অবহেলা দেখে। সে ঠিকই সবসময় ব্র্যান্ডের ঘড়ি, পোশাক পরত এবং আমাদের সন্তান টানাপড়েনের ভেতর জীবন কাটাত। একপর্যায়ে জানতে পারি, তার অন্যত্র সম্পর্ক রয়েছে এবং সে সেই নারীর সঙ্গে জীবন কাটাতে চায়। তারপর সেই সংসার ছেড়ে চলে এলাম মায়ের বাড়িতে। মায়ের পরিবার খুব সাপোর্ট করেছে সবসময়, নাহলে আমার পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হতো। আমার ভাই থাকে ফিনল্যান্ডে। সে আমাকে আর আমার ছেলেকে ফিনল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করলো। ফিনল্যান্ডে এসে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করালাম আর আমি একটা কাজ জোগাড় করলাম। তিন বছর হলো ফিনল্যান্ডে আছি। এখন বেশ ভালোই আছি।’
দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, দেশে থেকেও তো সন্তানকে মানুষ করা যেত- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘একা মায়েদের জন্য আমাদের দেশটা ঠিক সহজ নয়। সমাজের বাঁকা চোখ, লোকের নিন্দা শুনে জীবন পার করা কঠিন হতো। আর তাছাড়া আমার ছেলের জীবনটাও দুর্বিষহ হয়ে উঠত, তাই দেশ ছেড়ে আসা। উন্নত দেশগুলোয় একা মায়ের চিত্র খুব নরমাল। এখানে অন্তত সমাজের সঙ্গে কোনো লড়াই করতে হয় না।’
একা মায়ের সন্তানদের ওপর প্রভাব
একটা সুখী যুগল পরিবারে সন্তানদের বেড়ে ওঠা আর একা মায়ের পরিবারে বড় হওয়া সন্তানদের জীবনযাপনে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। এটা ঠিক, সব পরিবার সুখী নয়। সেক্ষেত্রে একটা অসুখী পরিবারে সন্তানকে বড় করার চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। নাহলে সেই অসুখী পরিবারের প্রভাব সন্তানের পুরো জীবনের ওপর পড়ে। তবে, সন্তানের ওপর মা এবং বাবা উভয়ের ছায়া থাকাই সবচেয়ে সুন্দর এবং নিরাপদ। কিন্তু যখন মা একা সন্তানকে লালনপালন করতে বাধ্য হন, তখন সন্তানের ওপর তার প্রভাব কেমন হয়?
সাধারণভাবে যদি দেখা হয়, সন্তানের জীবনের বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। সে বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। সে যখন অন্যদের দেখে বাবারা তাদের সন্তানদের ভালোবাসছে, তখন তার ভেতরে এক অবর্ণনীয় কষ্ট দানা বাঁধে। দিনের পর দিন সেই কষ্ট তার মনোজগতের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বাবা নেই বলে সমাজ তাকে যেই কটাক্ষ করে সবসময়, বিভিন্ন জায়গায় হেয় হতে হয় বা নেতিবাচক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, এটা আরও বেশি ক্ষতিকর। সন্তানটি ভাবতে থাকে, অন্য আট দশ জনের মতো তার জীবন কেন সহজ স্বাভাবিক নয়, কেন তার বাবা নেই। কখনো কখনো সে মাকেও দোষারোপ করে ফেলে। কারণ, সমাজ তার মাথায় এই ধারণা ঢুকিয়ে দেয় যে, এসবের জন্য তার মা-ই দায়ী।
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। জেসমিন আক্তার নামের একজন নারীর দুই সন্তান- একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে তিনি সংসার ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। একাই মানুষ করতে থাকেন দুই সন্তানকে। একপর্যায়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান সন্তানদের নিয়ে।
সন্তানদের তিনি মানুষের মতো মানুষ করে তোলেন। এখন দুটি সন্তানই কর্মজীবী। এমনকি তারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন তারা নিজ দায়িত্বে মাকে আবার বিয়ে দেন। যেন মা জীবনের শেষ দিনগুলো একাকিত্বে না ভোগেন। একজন ভালো বন্ধু পান।
একা মায়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত
যেহেতু একা মায়ের সংগ্রাম কঠিন, তাই সমাজের মানুষের উচিত তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, সহযোগী মনোভাব পোষণ করা। তাদের দোষারাপ করে, কটাক্ষ করে তাদের চলার পথ অমসৃণ করে না তুলে বরং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। আর সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দরকার মা-বাবার পরিবারের। বেশির ভাগ মেয়ে এমন পরিস্থিতিতে মা-বাবার পরিবার থেকে সহযোগিতা পান না। ফলে, তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
জেসমিন আক্তারের কথাই বলা যাক, তার বাবা তাকে বিয়ের দিন বলেছিলেন, ‘যদি কখনো শ্বশুরবাড়িতে এমন কিছু ঘটে যা তোমার সম্মানে আঘাত করে, তাহলে দ্বিতীয়বার না ভেবেই আমাদের কাছে চলে এসো। এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য চিরকাল খোলাই থাকবে।’ প্রতিটি মা-বাবা যদি এমনভাবে পাশে থাকেন, তাহলে একা মায়েরা সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়েও সংগ্রাম করে যেতে পারবেন, টিকে থাকতে পারবেন।
জাহ্নবী