লোকসানের কারণে খুলনায় একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা বন্ধ হয়েছে। গত দুই দশকে নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, চিংড়ি কারখানা ও জুটমিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
একসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে খুলনায় ছুটে আসতেন। কিন্তু শিল্পনগরী এখন সেই অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিক তদারকি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব, মান্ধাতা আমলের পাটকল, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ ও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বন্ধ হয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া উন্নয়নকাজে ধীরগতি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে অনিশ্চয়তায় সংকট আরও বাড়ছে।
জানা গেছে, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী খুলনা মহানগরীর লোকসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। এখন বেড়ে লোকসংখ্যা হওয়া উচিত ২০ লাখ অথচ কমে হয়েছে ১৩ লাখ। কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে বলে দাবি করছেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ্জামান জানান, খুলনায় একসময় চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা ছিল ৫৯টি। যার বেশিরভাগ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে ৩০ হাজারের বেশি স্থায়ী ও বদলি শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি করতেন। তারা সবাই এখন চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, খুলনার উন্নয়নে সব বন্ধ কল-কারখানা চালু করতে হবে। নতুন কল-কারখানা স্থাপন করতে হবে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পদ্মা সেতু ও মোংলা বন্দরের উন্নয়নকে কাজে লাগাতে হবে। নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে। তা হলেই কর্মসংস্থানের নগরী হিসেবে অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে খুলনা।
দারিদ্র্যের হার কমছে কর্মসংস্থান কমছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে (এইচআইইএস) দেখা গেছে, খুলনায় ২০১৬ সালে ছিল দারিদ্র্যের হার ছিল ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে দরিদ্রতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও কমেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়াস টার্ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে কর্মসংস্থানে দেশের শীর্ষ পাঁচ শহরের তালিকায় খুলনা ছিল পঞ্চম। ওই সময় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থান ছিল খুলনায়। তবে ২০১২ সালের পর সেই অবস্থান হারিয়েছে খুলনা। ২ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে তালিকায় পঞ্চম স্থানে আসে সিরাজগঞ্জ।
যেভাবে কমেছে কর্মসংস্থান: কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি ও মুনাফা হ্রাস পাওয়ায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় হার্ডবোর্ড মিল। এর আগে আর্থিক লোকসানে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর বন্ধ হয় নিউজপ্রিন্ট মিল। এতে দুই মিলের প্রায় তিন হাজার শ্রমিক চাকরি হারান। একইভাবে লোকসানের অজুহাতে ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ করা হয়। এতে চরম বিপদে পড়েন এখানকার সাড়ে ৭০০ শ্রমিক-কর্মচারী।
২০২০ সালের ২ জুলাই খুলনার স্টার, প্লাটিনাম, কার্পেটিং, ইস্টার্ন, ক্রিসেন্ট, জেজেআই, দৌলতপুর ও আলীম জুট মিল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চাকরি হারান প্রায় ৩০ হাজার স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী। তবে খুলনার শিপইয়ার্ডও একসময় লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেওয়ার পর সঠিক তদারকি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
১৯৬৬ সালে ২৬৪টি প্লট নিয়ে খুলনার বিসিক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা। তবে এত বছর পরও বেশিরভাগ প্লট অব্যবহৃত পড়ে আছে। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকে। বিমানবন্দর তৈরির প্রকল্প আটকে গেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলও অনিশ্চয়তায়। ব্যবসা অনুকূল পরিবেশ না থাকায় প্রত্যাশা অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না বিনিয়োগও হচ্ছে না।
আঞ্চলিক উন্নয়নে সম্ভাবনা: খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুল খবরের কাগজকে জানান, দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের জন্য খুলনার রূপসা এবং বটিয়াঘাটাতে দুটি পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে বড় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য খুলনায় আইটি পার্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান। সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থানে ঘুরে দাঁড়াবে খুলনা।
দারিদ্র্যের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও কমেছে: বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ্জামান বলেন, খুলনার বিভিন্ন শিল্প কল-কারখানা বন্ধ হওয়ায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। এদের অধিকাংশ জীবনের তাগিদে খুলনা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে বা অন্য শহরে গেছেন। ফলে খুলনা নগরীর খালিশপুর দৌলতপুর অঞ্চলের জনসংখ্যাও কমেছে। শ্রমিক শ্রেণির মানুষ ওই অঞ্চলে কমে যাওয়ায় পরিসংখ্যান অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম দেখালেও মূলত কর্মসংস্থানের সক্ষমতা হারিয়েছে খুলনা।
তবে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বিশ্বাস বুলু বলেছেন, এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে। মোংলা বন্দরের সাথে সারা দেশের রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হওয়ায় কম খরচে দ্রুত আমদানি-রপ্তানি করা পণ্য পরিবহন করা যাবে। বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশসহ ভারত, ভুটান, নেপাল অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এর মধ্য দিয়ে খুলনা মহানগরীর ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে বলে আশা করছি।