পরিবারের অভাব ঘুচাতে সৌদি আরবে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন রাজু আহমেদ (২৪)। মাকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছিলেন সেই স্বপ্নের কথা। বলেছিলেন, পরিবারের হাল ধরবেন। সৌদি আরবে যেতে পারলে, কাজের ফাঁকে হজ করবেন বলেও জানিয়েছিলেন মাকে। কিন্তু পর দিনই বুলেটের আঘাতে নিথর হলেন রাজু। ছেলের বলা সেসব কথা স্মরণ করে ক্ষণে ক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৯ জুলাই ঢাকা ছিল উত্তাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছিল। সেদিন গুলিতে রাজুসহ মাগুরার তিনজন নিহত হন। পরিবারগুলোতে এখন চলছে কান্নার রোল।
রাজু ছিলেন মাগুরা সদর উপজেলার আজমপুর গ্রামের কালাম মোল্যার ছেলে। অন্য দুজন শ্রীপুর উপজেলার বরইচারা গ্রামের আক্কাস মোল্যার ছেলে মুসতাকিন বিল্লাহ (২৮) ও নহাটা গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে আসিফ ইকবাল রাব্বি (৩৪)। তারা তিনজনই পরিবারের অভাব দূর করতে বাড়ি ছেড়েছিলেন।
রাজু আহমেদ জগদল সম্মিলনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মাগুরা আদর্শ কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তিন বছর আগে মা নাছিমা খাতুন বাড়িতে পাওয়ার টিলার দুর্ঘটনায় আহত হন। মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পড়াশোনা ঠিকমতো চালাতে পারেননি রাজু। তার বাবা কালাম মোল্যা একজন দিনমজুর। অন্যের জমিতে কাজ করেন। রাজুর বড় ভাই মালয়েশিয়ায় কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে ৩ মাস আগে বাড়ি ফিরে আসেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজু বাড়ি ছাড়েন। ৩ মাস ধরে ঢাকায় জননী কুরিয়ার সার্ভিসে বুকিং অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন।
রাজুর স্বজনরা জানিয়েছেন, ১৯ জুলাই শুক্রবার রাজু কয়েকজন বন্ধু মিলে কালো পাঞ্জাবি পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মা নাছিমা খাতুন রাজুর পোশাক, বই, ব্যাগ, কাঁথা-বালিশ দেখিয়ে বিলাপ করছেন।
নাছিমা বলেন, ‘আগের রাতেও রাজুর সঙ্গে কথা হয়। মোবাইলে সবার খবর নিছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। সর্বশেষ আমাকে বলল, পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত নিয়ে এসে চাচার কাছে দাও যাতে সৌদি আরব যেতে পারি। সেখানে গেলে হজ করতে পারব।’
এদিকে শ্রীপুর উপজেলার নহাটা গ্রামের আসিফ ইকবাল রাব্বি পড়াশোনা শেষ করে সম্প্রতি ঢাকায় একটি বায়িং হাউসে চাকরি শুরু করেন। একই উপজেলার বরইচারা গ্রামের মুসতাকিন বিল্লাহ মিরপুরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করতেন।
আসিফ ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর ফলপট্টি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তাকে। মুসতাকিন বিল্লাহ মিরপুর-১০ গোলচত্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হলে সেখান থেকে তাকে মিরপুর-১ গ্লোবাল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
পর দিন ২০ জুলাই তিনজনের লাশ মাগুরার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। আজও তাদের শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা।