‘সারাক্ষণ ডিউটি ডিউটি ডিউটি। সকালে দুইডা খাতিও পারে না। আমার জীবনডা (কনস্টেবল সুমন) এখন মারা গেছে। তাকে ফিরাইয়ে দিয়ে যাও।’
খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় এভাবে আহাজারি করছেন নিহত পুলিশ কনস্টেবল সুমন ঘরামীর স্ত্রী মিতু বিশ্বাস। তার আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না আত্মীয়স্বজন ও পুলিশ সদস্যরাও। যাকে কাছে পাচ্ছেন তার হাত-পা জড়িয়ে ধরে স্বামীর জীবন ফেরত চাইছেন। ছয় বছরের মেয়ে স্নিগ্ধা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি বাবা চিরতরে হারিয়ে গেছেন। সারাক্ষণ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে।
গত শুক্রবার রাতে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক হাসপাতালে হতাহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গেলে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
শুক্রবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় খুলনার গল্লামারী মোহাম্মদনগর এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশ কনস্টেবল সুমন ঘরামীকে। এ ঘটনায় আহত হন আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য।
হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুমনের স্ত্রী। চোখের পানি থামাতে পারেননি পুলিশ কমিশনার নিজেও। বললেন, ‘পুলিশ ধৈর্য দেখিয়েছে। কোথাও গুলি ছোড়েনি। তারপরও ওরা আমার ভাইকে হত্যা করল।’ এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যদের চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।
এদিকে শনিবার বেলা ২টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কনস্টেবল সুমন ঘরামীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তার মাথায় ও শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাসপাতাল থেকে সুমনের লাশ খুলনা পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়েছে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানানো শেষে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়ায় লাশ দাফন করা হয়।
জানা যায়, সুমন ঘরামীর বাড়ি বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলায়। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন নগরীর বয়রা এলাকায়। তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সোনাডাঙ্গা জোনের সহকারী কমিশনার সৌমেন বিশ্বাসের দেহরক্ষী ছিলেন।
থমথমে পরিস্থিতি, সহিংসতার তিন মামলা
খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় পাঁচ হাজারের বেশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
এর মধ্যে কনস্টেবল সুমন ঘরামী হত্যার ঘটনায় লবণচরা থানায় মামলা হয়। লবণচরা থানা-পুলিশের এসআই মোস্তফা সাকলাইন বাদী হয়ে শুক্রবার রাতে মামলাটি করেন। শুক্রবার বিকেলে গল্লামারী মোহাম্মদনগর এলাকায় সুমন ঘরামীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া নাশকতা, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগে খুলনা সদর থানা ও হরিণটানা থানায় আরও দুটি মামলা হয়। মোট তিন মামলায় অজ্ঞাত চার থেকে পাঁচ হাজার জনকে আসামি করা হয়। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক তিনটি মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বাগেরহাটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, খুলনায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল সুমন ঘরামীর লাশ গতকাল বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কিসমত মালিপাটন গ্রামে সমাহিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা বাবার বীর নিবাসের সামনে ধর্মীয় রীতি মোতাবেক তার লাশ সমাহিত করা হয়।
এর আগে বিকেল ৫টায় সুমনের লাশ মালিপাটন গ্রামে পৌঁছলে সেখানে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে মালিপাটন গ্রাম। এ সময় কচুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বাবু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাখি ব্যানার্জি, বাগেরহাট সদর সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাসুদ রানা, কচুয়া থানা অফিসার ইনচার্জ মো. মহসিন হোসেন উপস্থিত থেকে নিহতের লাশ গ্রহণ করেন।
পরে পুলিশের একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে বাবার বীর নিবাসের সামনে সমাহিত করা হয়। তিনি স্ত্রী, ছয় বছরের মেয়ে, বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাইবোনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।