সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় নিহত ১৪ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আটজনের লাশ পাশের মসজিদের সামনে স্তূপাকারে রাখা হয়েছিল। তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে পাশের পুকুরে। একজনের লাশ পড়ে ছিল পাশের রাস্তায়। অন্য একজনের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর পরের দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়।
হামলায় আহত পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুর আলম সেই দিনের ওই বর্বরতার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ওই দিন সকাল ১০টার দিকে আন্দোলনকারীরা এনায়েতপুর কেজির মোড় এলাকায় একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এরপর মিছিলটি থানার দিকে আসে। থানার সামনে এসে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় আমরা তাদের অনুরোধ করে বলতে থাকি, এটি জনগণের প্রতিষ্ঠান। আমাদের এমন অনুরোধে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আবারও তারা একটি মিছিল নিয়ে এসে থানায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন।’
তিনি আরও বলেন, এ সময় তাদের অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর বেশ কিছুক্ষণ পর দুপুর ১টার দিকে আবারও একটি বড় মিছিল এসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে থানার ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলেও লাভ হয়নি। পরে আমরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও তারা চার থেকে পাঁচ হাজার লোক থানার চারপাশের এলাকা ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। সে সময় আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি।’
পরিদর্শক শাহিনুর আলম বলেন, এরপর আন্দোলনকারীরা থানায় প্রবেশ করেই আগুন দেয়। এ সময় থানা কার্যালয়ের নিচতলায় থাকা আমরা ৯ জন পুলিশ সদস্য কৌশলে ভবনের ছাদের ওপরে গিয়ে পানির ট্যাংকের নিচে লুকিয়ে যাই। হামলাকারীরা প্রথমে থানা কার্যালয়ের নিচতলায় মূল ফটকে অগ্নিসংযোগ করায় আর ওপরে ওঠেনি। আমরা ৯ জন পুলিশ সদস্য সেই পানির ট্যাংকের নিচে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করি। এ সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার পর দীর্ঘসময়েও কোনো উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়নি। এরপর সন্ধ্যায় সেনা সদস্যদের গাড়ির হুইসেল শুনে আমরা সেখান থেকে বের হই। তারা আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।’
এ ছাড়াও সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলনকারীরা যে হামলা চালিয়েছেন, তাতে রক্ষা পাননি থানাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাকও। থানা থেকে বেরিয়ে এলে হামলাকারীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। নিহত অন্য ১৩ জনের মধ্যে চারজন উপ-পরিদর্শক (এসআই), একজন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ও আটজন কনস্টেবল রয়েছেন। গত রবিবার রাতেই নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। পরে তাদের লাশগুলো মর্গে পাঠানো হয়।
নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন ওসি আব্দুর রাজ্জাক, এসআই আনিসুর রহমান, তৌহেদুজ্জামান, প্রণবেশ ও রহিত; এএসআই ওবায়দুর রহমান এবং কনস্টেবল আবু তালেব, হাফিজুর রহমান, রবিউল ইসলাম, হানিফ, আরিফুল ইসলাম, শাহীন ও রিয়াজুল ইসলাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, গত রবিবার সকালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় জনতা মিছিল বের করেন। দুপুর ১টার দিকে তারা এনায়েতপুর থানার সামনে আসেন এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ তখন রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। আন্দোলনকারীরা তখন থানার সীমানাপ্রাচীরের ওপরের কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন। গুলির শব্দ চলে দুপুর একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। পাঁচ থেকে ছয়জন পুলিশ সদস্য থানার পেছন দিয়ে দৌঁড়ে পাশের একটি বাড়ির ভেতর ঢুকে আশ্রয় নেন। পরে তারা দৌড়ে বাড়ির পেছনে থাকা একটি পাকা বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পড়েন। কিন্তু হামলাকারীরা তাদের পিছু নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে খুঁজে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে। তবে এ হত্যাকারীরা কেউই স্থানীয় নন, সবাই ছিল অপরিচিত মুখ।
তারা আরও জানান, এরপর তারা থানার বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রাণরক্ষায় তখন পুলিশ সদস্যরা থানা থেকে বের হয়ে এলে তাদের ধরে ধরে পেটানো হয়। পিটুনিতে একে একে যখন পুলিশ সদস্যরা মারা যান, তখন লাশ স্তূপাকারে রাখা হয়। এ ছাড়া পুকুরপাড়ে ধরে যে তিনজনকে মারধর করা হয়, মৃত্যুর পর তাদের লাশ পুকুরেই ফেলা হয়। থানার পাশে অন্য একজনের লাশ গলায় ফাঁস দিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা রাস্তার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার কারণে অতিরিক্ত পুলিশ এ থানায় পৌঁছাতে পারেনি। পরে সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী থানায় পৌঁছে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে।
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউর রহমান বলেন, ‘থানায় ৩৬ জনের মতো পুলিশ সদস্য ছিলেন। বাকিরা কোনো রকমে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। তারা বেশির ভাগই মারধরে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।