টানা ভারী বৃষ্টি ও কুমিল্লা-ফেনী থেকে নেমে আসা ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নোয়াখালীর ২০ লাখ অধিবাসী। এদের বেশির ভাগই খাবার ও বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
জেলার ৯ উপজেলার সবকটিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। এতে লোকজনের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে স্থানীয়রা।
জানা গেছে, জেলার সদর, সুবর্ণচর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর উপজেলার বেশির ভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন এসব উপজেলার বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে আমন ধানের বীজতলা, শাক-সবজি। এ ছাড়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে।
এদিকে গত বুধবার রাতে বৃষ্টি বন্ধ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রবল বর্ষণে পানি বেড়ে গিয়ে মানুষ আরও দুর্ভোগে পড়েছে। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ডায়েরিয়া ও পেটের পীড়া রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
নোয়াখালী আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলায় ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী বর্ষণ হতে পারে।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তাঘাট ডুবে এখন মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকে গেছে। মাছের ঘেরসহ সব ভেসে গেছে। এত পানি ষাট বছর বয়সে কখনো দেখিনি। বৃষ্টি হলে পানি নেমে যায়। কিন্তু এবার পানি নামছে না। পানিবাহিত অসুখ বেড়েই চলছে।’
কবিরহাট উপজেলার বাসিন্দা রুবেল বলেন, ‘হাঁটু পানি দিয়ে আমাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করেছে প্রভাবশালীরা। খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও খাল দখল করে বাড়িঘরও নির্মাণ করা হয়েছে। এর কারণে পানি নামছে না। সেনাবাহিনী এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে খাল পরিষ্কার করে দিলে জলাবদ্ধতা থাকত না।’
কবিরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আলাবক্স তাহের টিটু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজ আরজু নামে আমার এলাকার এক ভাই মারা গেছেন। বেলা ১১টায় তার জানাজা পড়ে দাফন করার কোনো জায়গা পাই নাই। পরে আড়াই কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় কোনোমতে দাফন করেছি।’
সুবর্ণচর উপজেলার হারিচ চৌধুরীর বাজার এলাকার বাসিন্দা ফারজানা আক্তার বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে পানি জমেছে। রান্নাঘরেও পানি। পানির কারণে আজ রান্নাও করতে পারিনি। টিউবওয়েলের পানিতে ময়লা আসে।’
সেনবাগ উপজেলার ইব্রাহিম বলেন, ‘বেশির ভাগ এলাকার কৃষি জমি তলিয়ে গেছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। প্রশাসন যদি পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিত, তা হলে কৃষকরা বাঁচতে পারত।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী খবরের কাগজকে বলেন, ‘মুছাপুর, চরফকিরা এবং চর এলাহী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধসংলগ্ন সব বাসিন্দা বেশি ঝুঁকিতে থাকায় তাদের নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় যাওয়ার অনুরোধ করেছি।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, ‘জেলার ৯ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়ন ও পৌরসভা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার জন। এর মধ্যে ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ১১৫ জন আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দি এলাকায় ৮৮টি মেডিকেল টিম খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছে।’
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। জেলার ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ১৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ও ১৭৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।’