বৃষ্টিতে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা খুব একটা পৌঁছায়নি বলে দাবি বন্যার্তদের। এদিকে লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। একটু ত্রাণের আশায় দুর্গতরা ছুটছেন মহাসড়কের দিকে। অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানিয়েছেন, দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। ইতোমধ্যে দেশের সব নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বুধবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
চলমান বন্যায় ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১২ জন, ফেনীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, খাগড়াছড়ি ১, নোয়াখালীতে ৬, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও কক্সবাজারে ৩ জন মারা গেছেন। মৌলভীবাজারে ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
তিনি জানান, ১১ জেলায় মোট ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন। ক্ষতিগ্রস্তদের মোট ৬১৯টি মেডিকেল টিম সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নগদ বরাদ্দ ১ কোটি বাড়িয়ে ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা করা হয়েছে।
নোয়াখালীতে পানি বেড়েছে
এ জেলায় গত মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত দেড় ফুটের মতো পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সবচেয়ে বেশি পানি বেড়েছে নোয়াখালী সদর উপজেলার কিছু এলাকা, বেগমগঞ্জ, চাটখিল ও সেনবাগ উপজেলায়।
নোয়াখালীর ৮টি উপজেলার ৮৭টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন প্রায় সোয়া দুই লাখ মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় সড়কের আশপাশের আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষ সহযোগিতা পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন বন্যার্তরা।
জেলা শহরের হাউজিং স্টেট এলাকার মোজাম্মেল হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে টানা বৃষ্টি হয়েছে। এতে বন্যার পানি আরও বেড়ে গেছে।’
সুবর্ণচরের চরজুবলী গ্রামের সিরাজ মিয়া বলেন, ‘রাস্তা ও বাড়ি তলিয়ে আছে। এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন।’
নোয়াখালী সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের আকবর হোসেন বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবারসংকট রয়েছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বেশি পানি থাকায় নৌকা ছাড়া যাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে সহায়তা পৌঁছাচ্ছে না। ওই সব এলাকায় মানুষ না খেয়েও আছেন।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) জেলা সাধারণ সম্পাদক আবু নাছের বলেন, সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, নোয়াখালীতে স্মরণকালের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে দুর্গম এলাকাগুলোতে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে সহায়তা আসছে। তারা বন্যার্তদের সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন।
৮৪৮ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি
বন্যায় এখন পর্যন্ত জেলাজুড়ে কৃষি খাতে ৮৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে ৬৩ হাজার ৭৯৪ হেক্টর জমির ফসল, যা অতীতের যেকোনো ক্ষতিকে ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
লক্ষ্মীপুরে ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই ঘিরে ধরছেন বন্যার্তরা
লক্ষ্মীপুরে এখনো পানিবন্দি আছেন জেলার ৯০ শতাংশ মানুষ। ৩০ হাজার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। হাজার হাজার পরিবার নিজ বাড়িতে পানিবন্দি হয়ে আছে। আবার কেউ কেউ চাঁদপুর-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে ও বিভিন্ন বেড়িবাঁধের পাশে প্লাস্টিক ও কাপড় টাঙিয়ে অস্থায়ী ঘরে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই ঘরের মালামাল খোয়া বা চুরি যাওয়ার ভয়ে কোথাও যাননি।
লক্ষ্মীপুর পুলিশ লাইনসের সামনের সড়কে অস্থায়ী দুটি ঘরে বসবাসকারী আবুল কালাম ও আবুল কাশেম খবরের কাগজকে বলেন, তাদের বসতভিটায় কোমরপানি। পানি বেড়ে যাওয়ায় আর টিকতে পারেননি। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে তারা প্লাস্টিক ও কাপড় দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করেছেন। সেখানে গরু-ছাগল নিয়ে বসবাস করছেন।
রাস্তার পাশে বসবাস করা আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা প্রায় ২০টি পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে এ রাস্তার পাশে থাকছি। দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের ঘরে পানি। বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে থাকতে পারছি না। এদিকে ঘরের মালামাল চুরির ভয় রয়েছে। তাই দূরে কোথাও না গিয়ে বাড়ির পাশের সড়কে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইউনুস মিয়া বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৪১৯ টন জিআর চাল ও ১০ লাখ নগদ টাকা (জিআর ক্যাশ) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলায় বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ পানিবন্দি এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৩০ হাজার মানুষ অবস্থান করছেন। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে খাদ্যসংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রত্যন্ত এলাকার নারী-পুরুষ ও শিশুরা একটু ত্রাণের আশায় মহাসড়কে এসে দলবদ্ধ হয়ে অবস্থান নিচ্ছেন। ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই তারা আটকানোর চেষ্টা করছেন। জেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজার থেকে লক্ষ্মীপুর শহর পর্যন্ত ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
সদর উপজেলার চরচামিতা এলাকায় আব্দুল মতিন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ঘরে হাঁটুপানিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দুই দিন ঘরে কোনো খাবার নেই। এক প্যাকেট ত্রাণের আশায় দুই কিলোমিটার পানি মাড়িয়ে তিনি মহাসড়কে এসেছেন। ২ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেও একটু খাবার জোটাতে পারেননি।
কুমিল্লায় বন্যার উন্নতি নেই
কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি কমলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি নেই। বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে এখনো লোকালয়ে ঢুকছে পানি। ফলে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। এ ছাড়া বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে এখনো ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ জেলার ১৪ উপজেলার ১০ লাখ ৬১ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি। কুমিল্লার ১৭ উপজেলার মধ্যে চান্দিনা, মেঘনা ও হোমনা উপজেলা ছাড়া অন্য ১৪টি উপজেলা বন্যাকবলিত। এর মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে অন্তত ৭টি উপজেলায়। সেগুলো হলো বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও বরুড়া। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত কিছু এলাকায় ত্রাণসহায়তা একেবারে অপ্রতুল। অতি দুর্ভোগে দিন কাটছে বানভাসিদের।
লাকসাম উপজেলার উত্তর দা ইউনিয়নের দিকধাইর গ্রামের বাসিন্দা নুরুন্নবী বলেন, ‘আমাদের এলাকাটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় এখানে ত্রাণসামগ্রী তেমন আসছেই না। বন্যায় বাড়িঘর প্লাবিত হওয়ার প্রথম এক সপ্তাহে এই এলাকায় কোনো ত্রাণ আসেনি। গত সোমবার নেত্রকোনা থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবী দল প্রথমবারের মতো আমাদের গ্রামে ত্রাণ নিয়ে আসে।’
একই চিত্র মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং প্রত্যন্ত এলাকার তথ্য না থাকায় এসব অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী তেমন আসছে না।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, ১২৫টি ইউনিয়নের ১০ লাখ ৬১ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত। মোট ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
এদিকে গোমতী নদীর ভাঙনের ফলে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হলেও বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। এ ছাড়া গোমতী ও ঘুংঘুর নদীর ভাঙা বাঁধ দিয়েও সদর উপজেলাসহ বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া প্লাবিত হচ্ছে। সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন, বুড়িচং উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার আট ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহার ইসলাম বলেন, ‘এখনো নতুন নতুন উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। আমরা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার প্রধান প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত গোমতীর পানি কোনো অংশে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার এবং কোনো অংশে ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে।
এদিকে গোমতী নদীর বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতের দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে বাঁধের ভাঙা অংশের দৈর্ঘ্য ৫০০ ফুট ছাড়িয়েছে। এই দুই উপজেলার চারপাশেই উঁচু উঁচু সড়ক থাকায় এবং পার্শ্ববর্তী সালদা ও ঘুংঘুর নদীর বাঁধ ভেঙে এ অঞ্চলের দিকেই ঢুকছে পানি। এ পানি সরে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই গোমতীর বাঁধের ভাঙা অংশ শিগগিরই মেরামতের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামতের বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নিচু অঞ্চল ছাড়া সব কটি এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে অনেক এলাকায় খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ আসেনি। পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার কোথাও কোথাও এখনো পানি রয়েছে।
সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় ট্রলি ও ট্রাকে করে নানা গন্তব্যে যাচ্ছেন মানুষ। দাগনভূঞা ও সোনাগাজী উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার পানি কমেছে। তবে কিছু স্থানে মানুষজন এখনো পানিবন্দি। এ ছাড়া সোনাগাজী ও ফেনী সদর উপজেলার কিছু এলাকায় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি রয়েছে।
এ জেলায় বন্যায় অন্তত সাড়ে ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে করে খাবার পাঠানো হচ্ছে। জেলায় একটি এবং ছয় উপজেলায় ছয়টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।