বন্যার পানি কমতে শুরু করায় লক্ষ্মীপুরে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত জেলার পাঁচটি উপজেলায় শিশুসহ দুই হাজারের বেশি মানুষ ডায়রিয়া, জ্বর ও চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ রোগীই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে সর্দি জ্বরে আক্রান্ত রোগী। দুই দিন ধরে স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। শয্যাসংকটের কারণে অনেক রোগীর ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্যালাইনসহ ডায়রিয়ার জরুরি ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনছেন রোগীর স্বজনরা।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ডায়রিয়া ওয়ার্ডের প্রতিটি বেডে একাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে অনেককে। নার্সসংকটে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় ঠেলে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। একই চিত্র দেখা গেছে, জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের নার্স নোমান হোসেন বলেন, ‘১০ বেডের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বর্তমানে ভর্তিই আছেন ১২৫ জন রোগী। দু-একজন নার্স দিয়ে এত রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা খুবই কষ্টকর। একজনের স্যালাইন লাগাতে গেলে ১০ জন ডাকেন ওষুধ দিতে। তার ওপর স্যালাইনসহ ডায়রিয়ার ওষুধসংকট। রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনে এনে দিচ্ছেন।’
সাত মাসের শিশু মিরাজ দুই দিন ধরে জ্বর ও ডায়রিয়ায় ভুগছে। তার মা তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘১০ দিন ধরে আমাদের বাড়িতে কোমরসমান পানিতে আমরা বন্দি আছি। টয়লেট ও ডোবার নোংরা বন্যার পানিতে মিশে গেছে। এখন আমার সাত মাসের ছেলের জ্বর আর ডায়রিয়া। খুব খারাপ অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে এসে অস্বস্তিতে পড়েছি। গুদাম ঘরের মতো পরিস্থিতি। আরও দুজন রোগীর সঙ্গে একই শয্যায় আমার ছেলের চিকিৎসা চলছে।’
শহরের মুক্তিগঞ্জ থেকে শিশুকন্যা তাসুকে নিয়ে ভর্তি দিনমজুর খোকন বলেন, ‘বন্যার পানি পচে চারদিকে ডায়রিয়াসহ নানা রোগবালাই দেখা দিয়েছে। আমার ১০ বছরের মেয়ে ডায়রিয়ায় ভুগছে। একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে সে। কিছু বললে নার্সরা বলেন ওষুধ নাই। স্যালাইনসহ সব ওষুধই বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।’
চর লরেন্স থেকে আসা সামছুন নাহার, সদরের চৌধুরী বাজার এলাকা থেকে আসা ইমনসহ কয়েকজন রোগীর স্বজন বলেন, ‘শয্যা পাননি। তাই মেঝেতে বিছানা পেতে আছেন। ময়লা, দুর্গন্ধ আর রোগীর ভিড়ে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। এখানে চিকিৎসা করাতে এসে রোগীর পাশাপাশি আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’
ডায়রিয়া বিভাগের ইনচার্জ লিলু রানী দাস বলেন, গত তিন দিনে ডায়রিয়া ও জ্বর নিয়ে তিন শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৩২ জন গত শুক্রবার ভর্তি হলেও গত চার দিনে ডায়রিয়া ও জ্বর নিয়ে গণহারে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ১০ জনের বেড তো খালি নেই। মেঝেতেও হাঁটার জায়গা নেই। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে জেলার পাঁচটি উপজেলার ৪০০টি আশ্রয়ণকেন্দ্রে বাড়ছে ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। মেডিকেল টিমের কর্মীরা চিকিৎসাসেবা দিলেও তা অপর্যাপ্ত। মাবেতর জীবনযাপন করছেন আশ্রয়ণকেন্দ্রের বাসিন্দা ও বন্যার্ত স্থানীয় বাসিন্দারা।
লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আহমদ কবির জানান, বন্যার কারণে ডায়রিয়াসহ চারদিকে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে শুরু থেকে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬৪টি মেডিকেল টিমের সদস্যরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। তবে হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ায় কলেরার স্যালাইনসহ ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। শিগগির স্যালাইনসহ ওষুধ সরবরাহ করা হলে সংকট নিরসন করা হবে বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম/এমএ/