বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা, বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ঘটনায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ২০ কাউন্সিলরকে আসামি করা হয়েছে। বেশির ভাগ কাউন্সিলর একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন তারা। তবে সেখানে থেকেও কাউন্সিলর অফিসের বিভিন্ন নথিতে স্বাক্ষরসহ সার্বিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। মামলার পলাতক আসামি হয়েও কাউন্সিলরদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে রাজশাহীতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ১২নং ওয়ার্ডের কার্যালয়ে দেখা গেছে, কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু কার্যালয়ে নেই। তবে তার অনুপস্থিতিতেও অফিসের কাজে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। চারিত্রিক সনদ, জন্মসনদ, মৃত্যুসনদসহ বিভিন্ন কাগজে আগে থেকেই স্বাক্ষর করা আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাউন্সিলের এক কর্মচারী বলেন, ‘আগে থেকেই কাউন্সিলর অনেক নথিতে স্বাক্ষর করে রেখেছেন। এর বাইরে প্রয়োজন হলে তিনি ফাইল নিয়ে যেতে বলেন। নিয়ে গেলে তিনি সই করে দেন। আমাদের সব কাজই এখনো তিনিই করছেন।’ এ বিষয়ে জানতে সরিফুল ইসলাম বাবুর মোবাইলে কল দিলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ২নং ওয়ার্ডের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পুরোদমে কার্যক্রম চলছে। এমনকি সেখানে মাঝে মধ্যে কাউন্সিলর নিজে এসে বিভিন্ন নথিতে সই করেন বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নাগরিক কার্যক্রম সব কিছুই চালু আছে। আমি প্রতিদিনই অফিস করছি।’ মামলার ব্যাপারে বলেন, ‘এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেখার বিষয়।’
কাউন্সিলদের নামে করা সব মামলাই হয়েছে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায়। ফলে এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘মামলাগুলোতে যাদের নাম আছে তারা সবাই পলাতক আসামি। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। পলাতক আসামিদের অফিস করার ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে আলী রায়হান নিহত হন। তার মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলায় আট কাউন্সিলরকে আসামি করা হয়। তারা হলেন ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু, ১৩নং ওয়ার্ডের মো. আব্দুল মমিন, ১৪নং ওয়ার্ডের মো. আনোয়ার হোসেন, ১৭নং ওয়ার্ডের মো. শাহাদত আলী শাহু, ১৯নং ওয়ার্ডের মো. তৌহিদুল হক সুমন, ২১নং ওয়ার্ডের মো. নিযাম উল আযীম, ২৩নং ওয়ার্ডের মো. মাহাতাব হোসেন চৌধুরী ও ২৪নং ওয়ার্ডের মো. আরমান আলী। অন্যদিকে একই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব আনজুম সবুজের (২৫) মৃত্যুতে তিন কাউন্সিলরকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আনোয়ার হোসেন, ২২নং ওয়ার্ডের আবদুল হামিদ সরকার টেকন ও ২৪নং ওয়ার্ডের আরমান আলী।
এদিকে গুম-খুন ও বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনায় করা মামলায় ১০ কাউন্সিলরকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রজব আলী, ১৪নং ওয়ার্ডের মো. আনোয়ার হোসেন, ২৪নং ওয়ার্ডের মো. আরমান আলী, ১৩নং ওয়ার্ডের আবদুল মমিন, ১৯নং ওয়ার্ডের মো. তৌহিদুল হক সুমন, ২৩নং ওয়ার্ডের মাহাতাব হোসেন চৌধুরী, ১২নং ওয়ার্ডের সরিফুল ইসলাম বাবু, ২৭নং ওয়ার্ডের মো. মনিরুজ্জামান, ২১নং ওয়ার্ডের নিযাম উল আযীম ও ১৭নং ওয়ার্ডের শাহাদত আলী শাহু। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলা ও প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার মামলার আসামি করা হয়েছে, ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আকতারুজ্জামান কোয়েল, ২নং ওয়ার্ডের মো. নজরুল ইসলাম, ৪নং ওয়ার্ডের মো. আশরাফুল ইসলাম, ১নং ওয়ার্ডের রজব আলী, ২৫নং ওয়ার্ডের অলিফ আল মাহমুদ লুকেন, ৭নং ওয়ার্ডের মতিউর রহমান মতি, ৮নং ওয়ার্ডের জানে আলম জনি, ১৫নং ওয়ার্ডের আবদুস সোবাহান, ১৮নং ওয়ার্ডের শহিদুল ইসলাম পচা, ৯নং ওয়ার্ডের রাশেল জামান ও ২০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রবিউল ইসলামকে।
এদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯ অনুযায়ী দুটি কারণে কাউন্সিলরকে সাময়িক বরখাস্ত করা যাবে। প্রথমত, সরকার যেকোনো কারণেই করতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোনো মেয়র বা কাউন্সিলর যদি গ্রেপ্তার হন বা তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাসিকের কাউন্সিলর মিটিংয়ে যেন ফৌজদারি মামলার আসামিরা অংশ না নিতে পারে সেটি পুলিশকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জনগণের দায়িত্ব হলো আসামিদের ধরিয়ে দেওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত গোপনে তিনি কাজ করলে সেটি ঠেকানো যায় না।’
রাসিক প্রশাসক বলেন, ‘কোনো অপরাধী বা হত্যা মামলার আসামি আমার নাগরিকত্ব সনদ দেবেন, চরিত্রের সনদ দেবেন বা জন্ম নিবন্ধনে সই করবেন সেটি কাম্য নয়। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি।’