ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে জরিনা বেগমের কান্না এখন নিত্যসঙ্গী। ছেলে শেখ নয়নের অকালমৃত্যু যেন কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। ছেলের শোকে কখনো কখনো অস্বাভাবিক আচরণ করছেন তিনি। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিভে যায় নয়নের জীবনের প্রদীপ।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কামালখানি গ্রামের আলী হোসেন-জরিনা বেগম দম্পতির ছেলে নয়ন। তিন বছর আগে নয়নের বাবা মারা যান। এরপর থেকে আট সদস্যের পুরো পরিবারের দায়িত্ব ছিল নয়নের কাঁধে। অটোরিকশা চালিয়ে ধরেছিলেন সংসারের হাল। বড় দুই বোনের সহযোগিতা নিয়ে ভালোই চলছিল পরিবারটি। মা ও ছয় বোনের ‘নয়নের মণি’ নয়নকে নিয়েই ছিল তাদের যত স্বপ্ন। তবে একটি বুলেটের গুলি তছনছ করে দিল পুরো পরিবারকে। এখন নয়নের স্মৃতি আর কান্না ছাড়া কিছুই নেই এই পরিবারের।
নয়নের মা জরিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছয় মেয়ে আর এক ছেলে। আমার নয়নের মণি ছিল সে। তাই নামও রেখেছিলাম নয়ন। কিন্তু এভাবে আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলল! এখন আমি কী নিয়ে থাকব, কী নিয়ে বাচঁব! আমার ছেলেকে তোমরা এনে দাও।’
একই অবস্থা উপজেলার খন্দকার মহল্লার মাদ্রাসাছাত্র আনাসের পরিবারের। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট আনাস ছিল খুব আদরের। পরিবারের স্বপ্ন ছিল তাকে ইউরোপ পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে। সবকিছুর প্রস্তুতিও চলছিল। ভিসার কাজে গত ২৫ আগস্ট ভারত যাওয়ার কথা ছিল আনাসের। কিন্তু ৫ আগস্টই সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় তার পরিবারের। দেশের বৈষম্য দূর করতে আন্দোলনে যোগ দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
তার মা খাইরুন্নেছা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটা অনেক মেধাবী ছিল। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। কেন যে আনাস আন্দোলনে গেল, আর আমার বুকটা খালি হলো। এখন ওর ঘরে যাইতে পারি না। বুকটা ফেটে যায়। পরিবারের সবার ছোট ছিল আনাস। যে কারণে সবাই তাকে খুব ভালোবাসত।’
আনাসের বড় ভাই রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। আনাসকে ইউরোপ পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছিল। ২৫ আগস্ট ভিসার কাজে ভারত যাওয়ার কথা ছিল আনাসের। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের আনাস আর ফিরবে না।’
৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে মারা যায় হাসাইন মিয়া (১২)। হাসাইনের বাবা ছানু মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলেটা প্রতিদিনই এসে রংপুরের আবু সাঈদের গল্প শোনাত। সে বলত, আবু সাঈদ দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে। আমিও এই আন্দোলনে গিয়ে শহিদ হব। আমার নামও ইতিহাসে থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কি জানতাম, সত্যি সত্যি আমার ছেলেটা জীবন দিয়ে দেবে! আমার ছেলেকে এখন কোথায় পাব? আর কোথায় গেলে এর বিচার পাব?’
ওই দিন বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে বানিয়াচংয়ে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আটজন। আবার ছাত্র-জনতার হাতে এক পুলিশসহ দুজন প্রাণ হারান। এ ঘটনার এক মাস পার হলেও কান্না থামেনি নিহতদের পরিবারের।
উপজেলার বাসিন্দা মোজাম্মিল হক বলেন, ‘আমাদের বানিয়াচংয়ে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এক দিনে ১০টি জীবন শেষ হয়ে গেল। আমরা চাই এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দেওয়া হোক। একই সঙ্গে নিহতদের পরিবারগুলোকে যেন আর্থিক সহায়তা করা হয়, এটাই আমাদের দাবি।’
এদিকে তাদের মৃত্যুর ঘটনায় গত ২২ আগস্ট ১৬০ জনের নাম উল্লেখ করে বানিয়াচং থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়।