শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ফেনীর জনপদ। বন্যায় অন্যান্য খাতের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাতও। জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকসহ ৮৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭২ লাখ ৫০০ টাকা। এ ছাড়া গত ২০ আগস্ট থেকে জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজসহ ৯২৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আরও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ না ফেরায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৬০টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৯৯টি, মাদ্রাসা ১২৮টি, কলেজ ৩০টি এবং কারিগরি, ডিপ্লোমা ও প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০টি। এসব প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে বই ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া নষ্ট হয়ে যায় মোটর পাম্প, কম্পিউটার এবং প্রিন্টারসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ১০-১২ দিন পানি থাকায় মেঝে এবং বারান্দায় গর্তের সৃষ্টি হয়। আবার প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাঠদানের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। দ্রুত সংস্কার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন স্কুল প্রধানরা।
ফেনী পৌরসভার সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চয়নিকা চৌধুরী বলেন, ‘বন্যায় পুরো স্কুল ভবন ডুবে ছিল। স্কুলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আগামী রবিবার থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
জেলার শহিদ মেজর সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অর্চনা রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘দুর্যোগের সময়ে আমাদের বিদ্যালয়টিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বন্যার পানিতে বিদ্যালয়ের মেঝে মাটিতে ডেবে গেছে, আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। পুরো স্কুলের আনুমানিক ১৫ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। আমরা এসব বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করেছি। বাকি কক্ষগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে।’
ফেনী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দোলন কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘বন্যায় কলেজের বিভিন্ন আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ৪৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যার সময় কলেজ ভবনগুলোতে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। এখন প্রতিষ্ঠানের কোনো শ্রেণিকক্ষ ব্যবহারের উপযোগী নয়। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছি।’
এদিকে পানি নামলেও পাঠদানের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, বন্যায় অনেক শিক্ষার্থীর বই-খাতা ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আন্দোলনে মাঠে ছিল শিক্ষার্থীরা। এখন আবার বন্যা। এসব বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠদান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তারা। সব মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন অভিভাবকরা।
সদর উপজেলার ছকিনা আক্তার রুনা নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘বন্যায় বই-খাতা-কলম সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। বই-খাতা না থাকলে স্কুলে গিয়ে কি পড়বে! সবার আগে বই প্রয়োজন। এ ছাড়া একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বন্যার সময় জেলার ৫৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো পাঠদানে অনুপযোগী হয়ে আছে। শহর এলাকার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে যেসব শিক্ষার্থীদের বই-খাতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের তালিকা তৈরির জন্য বলা হয়েছে। তালিকা হাতে পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে।’
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফীউল্লাহ বলেন, ‘বন্যায় জেলার ৩৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ প্লাবিত হয়। এতে ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বরাদ্দের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে।’
জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইসরাত নুসরাত সিদ্দিকা বলেন, ‘৩৫৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০৬টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আসবাবপত্র, ভবন, সীমানা প্রাচীর এবং মাঠসহ ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাঠানো হয়েছে। সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’