যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় বিভিন্ন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অডিটের নামে শিক্ষক-কর্মচারীদের এক মাসের বেতনের প্রায় অর্ধকোটি ‘ঘুষ আদায়ের’ টাকা ফেরত পেতে ফুঁসে উঠেছেন ভুক্তভোগীরা। ঘটনার দুই বছর পর টাকা ফেরত চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ওই সময় শিক্ষকরা মুখ খুলতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার মনিরামপুর উপজেলার হাজরাকাঠি দারুল উলুম মহিলা আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক সৈয়দ আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা যশোরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষক ও কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, বেসরকারি শিক্ষকদের পাঠদান ছাড়া অন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ততার সুযোগ নেই। ফলে দুর্নীতি-অনিয়ম করার মতো কোনো ক্ষেত্রও নেই। অথচ ২০২২ সালের মার্চে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তা ড. এনামুল হক ‘মিনিস্ট্রি অডিটের’ নামে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভয় দেখিয়ে পুরো এক মাসের বেতন ঘুষ হিসেবে আদায় করেছেন।
কয়েকজন শিক্ষক জানান, ২০২২ সালের মার্চ মাসের শুরুতে যশোরের মনিরামপুর পৌর শহরের মনিরামপুর মহিলা আলিম মাদ্রাসা, হাজরাকাঠি মহিলা আলিম মাদ্রাসা, ডুমুরখালী দাখিল মাদ্রাসা, মনোহরপুর দাখিল মাদ্রাসা, বালিধা-পাঁচাকড়ি দাখিল মাদ্রাসা, রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজি আলী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দেলুয়াবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে অডিট করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক ড. এনামুল হক। পরিদর্শনকালে ওই ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০০ শিক্ষক-কর্মচারীর পুরো এক মাসের বেতনের প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। এ খবর পেয়ে ওই বছরের ১২ মে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সিলভিয়া ফেরদৌস ও আবুল কালামের নেতৃত্বে একটি দল শিক্ষা ভবনে অভিযুক্ত কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযান চালায়।
শিক্ষকরা স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেছেন, অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষক যা বেতন পান তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। তারপরও মাস শেষে হাতে গোনা বেতনের টাকা উত্তোলন করে সংসারের কেনাকাটা, বাচ্চাদের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও ঋণের কিস্তি দেন। কিন্তু সেই টাকাগুলো জোর করে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়ে অনেকেই অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এমনকি বিষয়টি শিক্ষা কর্মকর্তাদের জানানোর পর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তা ড. এনামুল হক ফের চাপ সৃষ্টি করে ‘আমরা ঘুষ দিইনি মর্মে প্রস্তুত করা চিঠিতে’ স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে দুদক ওই কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযান চালালেও খুব বেশি অগ্রসর হতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন তদন্তে এলে ওই কর্মকর্তার অনুসারীরা আমাদের পেনশন আটকে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করাতে বাধ্য করেন। এসব ভয় উপেক্ষা করে যারা সত্য বলবেন তাদের সাক্ষী নেননি তদন্তকারীরা।
ভুক্তভোগী শিক্ষক সৈয়দ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ওই সময় ড. এনামুলের ফেসবুকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তোলা ছবি দেওয়া ছিল। এতে সাধারণ শিক্ষকরা অবৈধ ক্ষমতার ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। বিশেষ করে সে সময় দেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলার কিংবা প্রতিবাদ করার উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পাওয়া বর্তমান সময়ে দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার এবং প্রতিবাদ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিক্ষকরা অবিলম্বে তদন্তপূর্বক ঘুষের টাকা ফেরত পেতে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে মানবিক আবেদন জানিয়েছেন। অন্যথায় কষ্টের বেতনের টাকা আদায়ে তাদের রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ড. এনামুল হক যশোরে এসে একটি রেস্ট হাউসে উঠে ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানকে দেখা করতে বলেন। এরপর সরাসরি বলেন, “আপনাদের অনেক ফাঁকফোকর আছে। প্রকৃত অডিট হলে কারও বেতন বন্ধ হবে, কারও পেনশন আটকে যাবে, কারও চাকরিটাও যাবে। এ জন্য আপনারা সবাইকে (সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের) বলে দিন বাড়াবাড়ি না করে এক মাসের বেতন দিতে, বাকিটা আমি ঠিক করে নেব। এরপর ভোজনবিলাস করে ‘আজব অডিট’ সম্পন্ন করেন।”
তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে শিক্ষকরা ঘুষ দিলেও পরে শিক্ষক সমাজে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। এতে নিজেকে বাঁচাতে ড. এনামুল হক ঘুষ নেননি মর্মে প্রত্যয়নে স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করিয়েছেন। এসব অপকর্মে প্রতিষ্ঠানপ্রধানরাও সহযোগিতা করায় তারাও কিছু ভাগ পেয়েছেন, যা নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে এই দুর্নীতিবাজের কাছ থেকে শিক্ষকদের রক্ত ঘামানো আয়ের টাকা আদায় করা হবে। প্রয়োজনে আমরা আন্দোলনে রাজপথে নামব।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ড. এনামুল হকের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইলফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর তিনি অফিসে নিয়মিত আসছেন না।