ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীতে উদগিরণ হওয়া গ্যাস প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে। চাপ নিয়ন্ত্রণ না করে এসব গ্যাস ব্যবহারের ফলে অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালী একটি চক্র বছরের পর বছর এভাবেই গ্যাস সংযোগ দিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তারা চান, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে তাদেরকে গ্যাস সরবরাহ করা হোক। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের উৎপত্তিস্থলের প্রেসার অনেক কম। যা দিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মেনে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব নয়। শিগগিরই ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মজলিশপুর ইউনিয়নের বাকাইল গ্রামে গেলে দেখা যাবে, রাস্তার দুপাশে গাছের ওপর প্লাস্টিকের পাইপ ঝুলছে। এই পাইপগুলো সরাসরি তিতাস নদী থেকে টানা হয়েছে। নদী থেকে উদগিরণ হওয়া গ্যাস এই পাইপগুলোর মাধ্যমে বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। গ্যাসের এই পাইপের কারণে গ্রামটিকে স্থানীয়রা ‘উড়াল গ্যাসের গ্রাম’ হিসেবে চেনেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, দেড় দশকের বেশি সময় আগে বাকাইল গ্রামসংলগ্ন তিতাস নদীর কয়েকটি জায়গায় গ্যাসের উদগিরণ শুরু হয়। তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ৩নং কূপ খননের সময় লিকেজের কারণেই এই গ্যাসের উদগিরণ হয় বলে জানা গেছে। কূপের গ্যাস মাটির ওপরের স্তরে চলে আসে এবং মাটির ফাঁকফোকর দিয়ে নলকূপ, নদীর পাড়, জমির আইল এবং বাড়ির আঙিনা দিয়ে উদগিরণ হতে থাকে। গ্যাসের এই উদগিরণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৭ সালে ৩নং কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। এরপর থেকে গ্যাসের উদগিরণও কমে আসে।
বাকাইল গ্রামের বাসিন্দারা এই গ্যাস যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের দেওয়ার দাবি জানালেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস প্রবাহ না থাকায় বিজিএফসিএল এ গ্যাস সংরক্ষণ বা উত্তোলনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, উদগিরণ হওয়া এই গ্যাস মূলত কূপের গভীরের লিকেজ হওয়া ‘পকেট গ্যাস’। এগুলো এক সময় শেষ হয়ে যাবে। বাণিজ্যিকভাবে এগুলো ব্যবহার বৈধ নয়। বাকাইল গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস প্রবাহ নেই। এখানে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো নলকূপের গভীরতার সমান। তবে বাসা-বাড়িতে বিজিএফসিএলর উৎপাদিত যে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তা অনেক গভীর এবং প্রেসারের।
বাকাইল গ্রামে দেখা গেছে, তিতাস নদীর যেসব স্থানে গ্যাস উদগিরণ হচ্ছে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ড্রামে করে পানিসহ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এরপর একটি পাইপ দিয়ে পানি বের করে আরেকটি পাইপ দিয়ে উত্তোলন করা গ্যাস কয়েক শ ঘর-বাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে। কয়েকটি চুন ও চুড়ির কারখানাও চলে বিজিএফসিএলর এই পকেট গ্যাস দিয়ে। যদিও এই গ্যাসের প্রেসার ওঠানামা করে।
স্থানীয় বাসিন্দা সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের গ্যাস আমরা বৈধভাবে ব্যবহার করি। ২০০৭ সালের আগে গ্যাস লিকেজ হয়েছে। গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তারা উড়াল গ্যাস বন্ধ করতে পারছেন না। যার কারণে ঝুঁকি আছে জেনেও আমরা উড়াল গ্যাস পাইপের মাধ্যমে এনে ব্যবহার করি।’ খসরু মিয়া নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গ্যাস উড়ে চলে যাচ্ছে। তাই আমরা কারও না কারও মাধ্যমে গ্যাস ব্যবহার করে থাকি।’
এ বিষয়ে নদী সুরক্ষাভিত্তিক সংগঠন ‘তরী বাংলাদেশ’র আহ্বায়ক শামীম আহমেদ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সংযোগ দিয়ে অবৈধ বাণিজ্য চলছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
উড়াল গ্যাসের বিষয়ে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন, ‘বাখরাবাদের উদ্যোগে এখানে অভিযান চালানোর সুযোগ খুবই সীমিত। জেলা প্রশাসন জনগণের স্বার্থে এখানে একটা উদ্যোগ নিতে পারে। আর যেহেতু গ্যাসফিল্ডের কোনো গ্যাসকূপ থেকেই এই গ্যাস আসছে, তাই তাদেরকেই এটা মনিটরিং করতে হবে।’
আইনি পদক্ষেপ প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন সুলতানা বলেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে শিগগিরই উদগিরিত গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার বন্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ২৪টি কূপ থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। ১৯৬২ সালে দেশের প্রাচীন এই গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করে পাকিস্তান শেল ওয়েল কোম্পানি।