
একসময় করতেন ডাকাতি। পরে শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে এখন প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক নারায়ণগঞ্জের ‘সাইনবোর্ডের ক্যাডার’খ্যাত আলমগীর হোসেন। অভিযোগ রয়েছে, জমি দখল, চাঁদাবাজি আর কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে স্থানীয়দের হয়রানি করতেন তিনি। এমনকি আন্দোলনের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাতে জড়িত ছিলেন সাবেক এমপি শামীম ওসমানের এই ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের মাহমুদপুর এলাকার ফজর আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন পুলিশের তালিকায় বহু আগে থেকেই চাঁদাবাজি মামলার আসামি। এক দশক আগে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজামের হাত ধরে তার রাজনীতিতে আসা। এরপর শ্রমিক লীগের নেতা থেকে হয়ে যান কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ১নং ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন দুর্ধর্ষ ক্যাডার। নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকা। সেখানে পরিবহন ও স্ট্যান্ড বসিয়ে চাঁদা তুলতেন আলমগীর। সড়কের পাশে সরকারি জায়গায় দোকান বসিয়ে নিতেন নিয়মিত চাঁদা। সে সময় পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় ভূইগড়, মাহমুদপুরসহ আশপাশের এলাকায় বিচার-সালিশ চলতো তার কথায়। স্থানীয়দের হয়রানি করতে আলমগীরের ছিল বিশাল কিশোর গ্যাং। তার বিরুদ্ধে গেলেই হামলা চালাতো ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা।
স্থানীয়রা আরও জানায়, জমি দখল, চাঁদাবাজি করে আলমগীর এখন প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই দেওয়া হয় একের পর এক মামলা। এরপর বাড়িঘর ভাঙচুরসহ হামলা চালায় তার নিয়ন্ত্রণে থাকা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ভূইগড় ও মাহমুদপুরেই আলমগীরের দোতলা ও চারতলার দুটি বাড়ি রয়েছে। কোটি টাকা মূল্যের কয়েকটি জায়গারও মালিক তিনি। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে দখলে রেখেছেন অন্যের সম্পত্তি। এমনকি জোর করে দখলে নিয়েছেন স্বজনদের সম্পত্তিও। মাহমুদপুর এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ আহাম্মেদের তিন কোটি টাকা মূল্যের জমি নামমাত্র দামে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিলেন আলমগীর। সেই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে তার বাড়িতে গিয়ে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন ওই ব্যবসায়ী।
আলমগীর হোসেনের চাচাতো ভাই ফতুল্লা থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আলমগীর রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এটি সবাই জানে। সাইনবোর্ডে পরিবহন, অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি করত নিয়মিত। শামীম ওসমানের ক্ষমতার প্রভাবে ও শাহ নিজামের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় এলাকার বহু মানুষের জায়গা-জমি আলমগীর দখল করেছে। এমনকি আমাকেও ছাড় দেয়নি। আমার জায়গায় দখল করে দেয়াল দিয়ে রেখেছে।’
আলমগীরের বাড়ির পাশে থাকা জমির মালিক র্যাবের সাবেক উপপরিদর্শক শাহ আলী বলেন, ‘২০০৩ সালে আমি এখানে ৬ শতাংশ জমি কিনেছিলাম। আলমগীর আমার সেই জমি দখল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালায়। এমনকি তার বাবা ফজর আলীকে দিয়ে জাল ওয়ারিশনামা তৈরি করে এসিল্যান্ড অফিসে মিথ্যা মামলা করে। এ ছাড়া চাচা মোহাম্মদ আলীকে দিয়েও আদালতে আরও একটি মামলা করে, যেন জমি বিক্রি করতে না পারি।’
এলাকার বহু মানুষের জায়গা আলমগীর দখল করেছে উল্লেখ করে শাহ আলী আরও বলেন, ‘জমি দখলের পর আলমগীর জমি কেনার জন্য প্রস্তাব পাঠায়। তবে সেটা স্বল্প মূল্যে। আলমগীরদের অত্যাচারে ও হামলা-মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এলাকাবাসী।’
ভূইগড়ের স্থানীয় বাসিন্দা শিখা আক্তার বলেন, ‘আমার চারতলা বাড়িসহ পুরো জমিটি মাত্র ৬০ লাখ টাকা দিয়ে আলমগীর লিখে নিয়েছে। অথচ আমার সেই ভিটের দামই এক কোটি টাকার বেশি। তাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম, আমার বাড়িটি ছাড়া আর কিছু নেই। আলমগীর কোনো কথা না শুনে হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে জমিটা দখল করে।’
শুধু জমি দখলই নয়, বিচারের নামে নারীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে শারীরিকভাবে অত্যাচারেরও অভিযোগ রয়েছে আলমগীরের বিরুদ্ধে। ভূইগড় এলাকার গৃহবধূ রত্না খাতুন বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়িতে কয়েকজন ভাড়াটিয়া থাকেন। তাদের সঙ্গে ভাড়ার টাকা নিয়ে ঝগড়া হয়। সেই ঘটনার সালিশ করার জন্য আমাকে ডেকে নেয় আলমগীর। এক পর্যায়ে সে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এমনকি কুপ্রস্তাবও দেয়।’
আলমগীরের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাইনবোর্ড থেকে মৌচাক পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় এই আলমগীর। তবে গত ৫ আগস্টের পর আলমগীর পালিয়ে গেলেও এখনো তার সহযোগীরা স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করে যাচ্ছে। এ ছাড়া এই আলমগীর ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যায় সরাসরি জড়িত বলে জানিয়েছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন। তিনি জানান, আলমগীরের বিরুদ্ধে হত্যাসহ অন্তত ৯টি মামলার তথ্য রয়েছে। পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজছে। দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
এ নিয়ে জানতে আলমগীরের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়ার পরও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার স্বজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা।’