সুনামগঞ্জে ৪ আগস্টের সরকার পতনের বিক্ষোভে যোগ দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন ১৪ বছরের তোফাজ্জল হোসেন। রৌজ গার্ডেন রেস্টুরেন্টে কর্মরত তোফাজ্জল বাম ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হন এবং দীর্ঘ চিকিৎসার পরও সুস্থ হয়নি সে। আর্থিক সংকটে তার পরিবার চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। স্থানীয়দের সহায়তায় চিকিৎসা চললেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে পরিবারটি এখন দিশাহারা। তোফাজ্জলকে সুস্থ করে তুলতে সবার কাছে মানবিক সহায়তা চেয়েছেন তার স্বজনরা।
গত ৪ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জ শহরও উত্তাল ছিল। সকাল থেকেই দিনটি ছিল থমথমে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা দখলে নেয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর এদের সঙ্গে যোগ দেয় কিশোর তোফাজ্জল। এদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে যাওয়ার পথে কামারখাল এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ আক্রমণ করে। পুলিশ নির্বিচারে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকা।
পুলিশের বেপরোয়া টিয়ারশেল আর রাবার বুলেটের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্র-জনতা পিছু হটতে থাকে। ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। একপর্যায়ে শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিশ্রামে থাকা রেস্টুরেন্টবয় তোফাজ্জল দেখতে পান যে তার মতো অনেক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছেন। কালক্ষেপণ না করে তোফাজ্জলও মিছিলে যোগ দেন। এ সময় পুলিশ আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। পুলিশের টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের তীব্রতায় টিকতে না পেরে ছাত্র-জনতার একটি অংশ সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কালেক্টরেট এলাকায় অবস্থান নেয়। পুলিশের টিয়ারশেলের ধোঁয়া আর ঝাঁজে পুরোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে কালেক্টরেট এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়।
ছাত্র-জনতার আরেক অংশ শহরের আরপিন নগর গলির ভেতর ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও রক্ষা হয়নি ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেওয়া তোফাজ্জল হোসেনের। আরপিন নগর কবরস্থান এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের গুলি তার বাম ঊরুতে বিদ্ধ হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তোফাজ্জলের বাড়ি সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটি সাফেলা গ্রামে। সম্প্রতি তার বাড়ি গিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য। ওই দিনের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তোফাজ্জল জানান, ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেলের মুখে টিকতে না পেরে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তিনিও আরপিন নগর গলির ভেতর ঢুকে পড়েন। এ সময় তিনি আরপিন নগর কবরস্থান এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ তাকে গুলি করে। গুলি তার বাম ঊরুতে বিদ্ধ হয়। তোফাজ্জল আরও জানান, ঊরুতে গুলি লাগার পর তিনি মাটিতে গড়াগড়ি করলেও পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি। মাটিতে গড়াগড়ির একপর্যায়ে রৌজ গার্ডেনের বাবুর্চি লিলু মিয়া তাকে উদ্ধার করে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে কয়েক দফা চিকিৎসা চলে তোফাজ্জলের। প্রথম দফা তার ঊরু থেকে দুই থেকে তিনটি গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। পরে বাড়িতে চলে আসেন তোফাজ্জল। কয়েক দিন পর ঊরুতে ব্যথা হলে আবারও সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এ সময় তার ঊরু থেকে আরও কয়েকটি গুলি বের করেন চিকিৎসক। এর পর আরেক দফা ঊরুতে ব্যথা শুরু হলে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন তোফাজ্জল। তৃতীয় দফা সদর হাসপাতালে ভর্তি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন।
তোফাজ্জল জানান, সিলেট ওসমানী মেডিকেলে যাওয়ার পর তার ঊরু থেকে আরও তিনটি গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। এরপর ডান ঊরু থেকে মাংস নিয়ে বাম ঊরুতে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়।
তোফাজ্জল আরও জানান, তিনি উপজেলার ইয়াকুব উল্লাহ পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পরিবারের অর্থকষ্ট লাঘবে তিনি রেস্টুরেন্টে চাকরি নেন।
সেদিন আহত তোফাজ্জলকে উদ্ধারের ভয়ঙ্কর বর্ণনা দেন রৌজ গার্ডেনের বাবুর্চি লিলু মিয়া। তিনি শুনতে পান তার রেস্টুরেন্টের বয় তোফাজ্জল পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। এ খবর শুনে তিনি বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাকে তিনি খুঁজে পান শহরের আরপিন নগর কবরস্থানের পাশের সড়কে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তোফাজ্জল তখন চিৎকার করছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকে উদ্ধার করে রেস্টুরেন্টের অন্যান্য বয়ের সহযোগিতায় সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে পাঠান।
তোফাজ্জলের মা মোছা. লুৎফা বেগম জানান, তার স্বামী একজন দিনমজুর। সংসার চলে না। তোফাজ্জল পরিবারের বড় ছেলে, তাই তাকে গত মে মাসে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জ রৌজ গার্ডেন রেস্টুরেন্টে চাকরিতে পাঠানো হয়।
তোফাজ্জলের বাবা মো. আকবর আলী জানান, দুই মেয়ে, দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার পরিবার। দিনমজুরি করে সংসার চলে না। তাই বড় ছেলে তোফাজ্জলকে সুনামগঞ্জ রৌজ গার্ডেন রেস্টুরেন্টে চাকরি দিয়েছেন। ছোট ছেলে রায়হান আহমদ গ্রামের (সাফেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ে)। বড় মেয়ে আকলিমা আক্তার সুমাইয়া (১৮) ও ছোট মেয়ে মাহমুদা বেগমকে (১৬) জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার আমবাড়ি পঞ্চগ্রাম মহিলা মাদ্রাসায় (আবাসিক) পড়তে দিয়েছেন। বড় মেয়ে এবার দশম শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলেন, ‘তোফাজ্জল এতদিন সংসারে সহায়তা করেছে। সবার ভরণপোষণে আমার সঙ্গে আর্থিক দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তোফাজ্জলই পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’
তিনি জানান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মনাজ্জির হোসেনের সহযোগিতায় চিকিৎসা খরচ চালানো হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবেও আরও কিছু আর্থিক সহযোগিতা তারা পেয়েছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। ছেলে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে সে জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মনাজ্জির হোসেন জানান, জেলা বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গসংগঠনগুলো চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জলকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। সূত্র: বাসস