দেশের সাতটি বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অন্যতম। কাগজে-কলমে সংরক্ষিত এ বনের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর হলেও বাস্তবে কতটুকু রয়েছে তা জানে না বন বিভাগ।
১৯৯৬ সালে এই বনকে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত ভূমি জরিপ হয়নি। এ ছাড়া সীমানা চিহ্নিত না থাকায় দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই উদ্যানের অনেক জমি বেদখল হয়ে গেছে। ভূমি জরিপ না হওয়ায় উদ্যানের কতটুকু জমি অবশিষ্ট রয়েছে, আর কতটুকু দখল হয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারছে না বন বিভাগ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এটি সংরক্ষিত বন। কাগজে-কলমে একে সংরক্ষিত বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নেই কোনো সীমানা প্রাচীর। এতে বনের চারপাশের জমি যে যেভাবে পেরেছেন দখলে নিয়েছেন। তৈরি করা হয়েছে চা-বাগান, লেবু ও আনারস বাগান, বাড়িসহ নানান স্থাপনা। বন বিভাগ মাঝে মধ্যে এসব জায়গা উদ্ধারে অভিযান চালায়। তবে সীমানা চিহ্ন না থাকায় তখন উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও বন বিভাগ জানিয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভূমি জরিপের জন্য এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু সীমানা চিহ্নিত না থাকায় তাদের উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামের চা-বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ ৩ নভেম্বর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জেনার আহমেদের দখলে থাকা প্রায় চার একর বনভূমি উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। পরে উদ্ধার করা সেই জায়গাগুলোতে বন্য প্রাণীর উপযোগী বিভিন্ন জাতের গাছের চারা লাগানো হয়।
জানা গেছে, লাউয়াছড়ার আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রচুর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রয়েছে। এই সুযোগে উদ্যানসংলগ্ন অনেকেই বনের জমি দখলে নিয়ে ফলের বাগান করেছেন। অনেকে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন স্থাপনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, এখানে অরক্ষিত কিছু জায়গা আছে, এগুলো মানুষের দখলে আছে। এর আগেও জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে এই জরিপ আর হয়নি। সীমানা নির্ধারণ করা হলে আর কেউ জায়গা দখল করতে পারবে না। একই সঙ্গে দখলকৃত জমি উদ্ধার করতে সহজ হবে বলে জানান তারা।
প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর এডভেঞ্জার ওয়াইল্ড লাইফ’র ফাউন্ডার সোহেল শ্যাম মনে করেন, ‘সীমানা নির্ধারণ না থাকায় এর আগেও বনের অনেক জমি দখল হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সীমানা নির্ধারণ না থাকায় সহজেই বনের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্যানের জায়গা পরিমাপ করে সীমানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, লাউয়াছড়ার কতটুকু জমি এখন পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে তা অনুমান করা কঠিন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জমির দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন ডিমারগেশন (পরিমাপ) করা হবে। ডিমারগেশন হয়ে গেলে প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে। এটি করা সম্ভব হলে দখলে থাকা সব জমি উদ্ধার করা সহজ হবে বলে জানান তিনি।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, লাউয়াছড়ায় কখনো জরিপ হয়নি। যেগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই রয়েছে। এখন জরিপটা গুরুত্বপূর্ণ। আগেও জরিপের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে আবার চিঠি দেওয়া হবে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বনটি বিখ্যাত। এ ছাড়া এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ। জীববৈচিত্র্যের টানে দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এ উদ্যানে বেড়াতে আসেন।