খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশ এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনেই গড়ে উঠছে ইজিবাইকের স্ট্যান্ড। প্রতিদিন সকাল থেকে কয়েক শ ইজিবাইকের হর্ন, চালকদের হাঁকডাক, যাত্রী ওঠানামার সময় যে পরিমাণ শব্দ হয়, সেটা নীরব এলাকার নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া হাসপাতালের সামনের সড়ক দিয়ে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলাচল করে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন। এর সঙ্গে আছে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রের তীব্র আওয়াজ। সব মিলিয়ে বিষিয়ে উঠেছে হাসপাতালের আশপাশের পরিবেশ।
‘নীরব এলাকা’ হিসেবে নির্ধারিত জায়গায় যখন শব্দের এত উৎপাত, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে পুরো শহরের অবস্থা কেমন? খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো শহরে সব সময় উচ্চ শব্দে বিভিন্ন কাজ করা হয়। এতে তাদের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। পরিবহন সংশ্লিষ্ট একজন জানিয়েছেন, কোথায় কতটুকু শব্দে হর্ন বাজালে মাত্রা ছাড়াবে তা তিনি জানেন না। এমনকি কোন এলাকায় কতটুকু শব্দে হর্ন বাজাতে হবে তাও নির্দিষ্ট করা থাকে না। একাধিক নাগরিক বলছেন, উচ্চ শব্দের যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে উদাসীন। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা নিয়মিত অভিযান চালায়। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সরেজমিনে খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় (প্রথম ফেজ) গিয়ে দেখা যায়, নিয়মনীতি ছাড়াই বহুতল ভবনের নির্মাণকাজে বিকট শব্দে মেশিনে ইট ভাঙার কাজ চলছে। এই শব্দে বিরক্ত এখানকার বাসিন্দারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০ ডেসিবেলের বেশি হলেই কানের ক্ষতি শুরু হয়। তবে খুলনা নগরীর বিভিন্ন স্থানে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ১৩২ ডেসিবেল পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, উচ্চ সাউন্ড সিস্টেম, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ঢালাই মেশিন ও অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন চলাচল শব্দদূষণের প্রধান কারণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর আওতায় নীরব ঘোষিত এলাকায় সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকা ৫৫ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকা ৭০ ডেসিবেল, শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবেলের বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্টির সুযোগ নেই। কিন্তু চলতি মাসেই সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে ৬৯.৭ ডেসিবেল, শান্তিধাম মোড়ে ৬২.৮ ও পিটিআই টুটপাড়া মোড়ে ৫৮.৪ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা পাওয়া যায়। এর আগে গল্লামারী মোড়ে ৮২ ডেসিবেল, ফুলবাড়ি গেট এলাকায় ৭৮ ডেসিবেল, ডাকবাংলা মোড়ে ৭৫, বিএল কলেজ মোড়ে ৭৩, ফুলবাড়ি গেটে ৭৮ ডেসিবেল শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া যায়। এসব জায়গায় আইন অমান্য করে উচ্চ শব্দের হর্ন বাজানো হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকার ৫০০ মিটারের মধ্যে উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। অনুমতি ছাড়া শব্দ সৃষ্টি করলে প্রথমবার অপরাধে একমাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইন থাকলেও এর বাস্তবায়নে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
গাড়িচালক মো. আল-আমিন জানান, গাড়ির হর্নের শব্দ কতটুকু হলে তা মাত্রা অতিক্রম করবে তা অনেকেই জানেন না। আবার কোন এলাকায় কত মাত্রার হর্ন বাজানো যাবে এরও সঠিক নির্দেশনাও সব জায়গায় থাকে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মমতাজ বেগম বলেন, চলতি সপ্তাহে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের অভিযোগে কয়েকটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় শব্দ সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করেছে। পরিবেশ আইন মানতে সচেতনতা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা জানান তিনি।