তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় জয়পুরহাটের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়লেও ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন তারা। এরপর সেই রস থেকে গুড় তৈরি করছেন। এখানকার গুড়ের মান ভালো হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে গুড় কিনতে আসছেন সাধারণ ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।
বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কুয়াশা ভেজা ভোরে গাছিরা গাছ থেকে রস ভর্তি মাটির হাঁড়ি নামাচ্ছেন। এরপর টিনের বড় তাওয়ায় বসিয়ে জ্বাল দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করছেন।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জয়পুরহাটে এবার প্রায় ৫০০ গাছি খেজুরের রস সংগ্রহ করতে এসেছেন। প্রায় ৪ মাস ধরে এই রস সংগ্রহ চলবে। চলতি মৌসুমে এ জেলায় ২০০ টন গুড় উৎপাদনের প্রত্যাশা করছে কৃষি বিভাগ।
রাজশাহী থেকে জয়পুরহাটের কুঠিবাড়ি ব্রিজ এলাকায় এসেছেন গাছি আনছার আলী। তিনি বলেন, ‘আমরা জয়পুরহাটে এসে কার্তিক মাসে বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়েছি। আমরা ৫ জন মিলে ৩৫০টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। ৩৫০টি গাছ থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ মণ রস সংগ্রহ হয়। এই রস থেকে প্রতিদিন ২-৩ মণ গুড় উৎপাদন হয়। পুরো মৌসুমে প্রায় ৫০০ মণ গুড় উৎপাদন করা হয়।’
একই জেলার হেলাল গাছি বলেন, ‘আমরা জয়পুরহাটের বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী ঘর বানিয়ে গুড় তৈরি করি। রাত ৩টার দিকে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে যাই। এরপর ভোরে সেই রস তাওয়ায় রেখে জ্বাল দেওয়া শুরু করি। এর ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর গুড় তৈরি হয়। ভালো মানের প্রতি কেজি গুড় ৪০০ টাকা, সাধারণটা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। গুড়ের পাশাপাশি ৮০ টাকা কেজিতে খেজুরের রস বিক্রি করি।’
মাজেদুল নামে অপর এক গাছি বলেন, ‘আমরা ৭ জন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করি। গুড় তৈরির পর ব্যবসায়ীরা ও সাধারণ ক্রেতারা কিনে নিয়ে যান। অনেকে রস খেতে আসেন। আমরা এখানে ভেজালমুক্ত গুড় উৎপাদন করি। সরকার থেকে যদি প্রশিক্ষণসহ অন্য সহযোগিতা পাওয়া যেত, তা হলে হয়তো আরও ভালোভাবে গুড় উৎপাদন বা বাজারজাত করতে পারতাম।’
বেল আমলা গ্রামের মনজিল হাসান মুরাদ নামে একজন ক্রেতা বলেন, ‘আমি গুড় কিনতে ও রস খাওয়ার জন্য এখানে এসেছিলাম। কুঠিবাড়ি ব্রিজের এখানে মানসম্মত গুড় ও খেজুরের রস পাওয়া যায়। এখানে এসে রস খেয়েছি। ১ কেজি গুড়ও কিনলাম।’
পাথুরিয়া গ্রাম থেকে গুড় কিনতে আসা এনতাজ বলেন, ‘বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এসেছেন। তাই পিঠা তৈরির জন্য গুড় কিনতে এসেছি।’ একই গ্রামের সিরাজুল ইসলাম নামে অপর ক্রেতা বলেন, ‘দুদিন আগে বাড়িতে মেয়ের জামাই এসেছে। এ জন্য চাল থেকে আটা করে নিয়ে এলাম। এখন পিঠা-পুলি করার জন্য এখান থেকে দেড় কেজি গুড় কিনলাম।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, ‘গাছিরা এবার প্রায় ১৫ হাজার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। শীতের সময় গুড়ের চাহিদা থাকায় গত বছরের চেয়ে এবার গাছির সংখ্যা বেড়েছে। এ মৌসুমে জেলায় ২০০ টন গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। গুড় উৎপাদন করার ক্ষেত্রে বাদুড় বা এই জাতীয় প্রাণী রসের সংস্পর্শে না আসে এ জন্য আমরা গাছিদের পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছি।’
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. রুহুল আমিন বলেন, ‘বাদুড় রাতে খেজুরের রস খায়। এ জন্য কাঁচা রস খেলে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। কোনোভাবেই কাঁচা রস খাওয়া যাবে না। রস ফুটিয়ে বা গুড় করে খাওয়া যাবে। কেউ যেন কাঁচা রস না খায় সে জন্য আমরা গাছিদের ও গ্রাহকদের সতর্ক করছি।’