রাত একটা বেজে পাঁচ মিনিট। রাতের আঁধার আরও গুমোট করেছে কুয়াশার জাল। সামনে কয়েক গজ দেখা গেলেও দৃষ্টিসীমা আটকে দিয়েছে তীব্র কুয়াশা। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাজার রোডে কাজী মার্কেটে গেলে কানে আসে মুহুর্মুহু বাঁশির শব্দ।
সড়কে দাঁড়াতেই এগিয়ে আসেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। মোটা কাপড়ে পুরো শরীর এমনভাবে ঢাকা যে চেনার উপায়ই নেই। তার নাম আবদুল মালেক। তিনি বণিক সমিতির নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী।
কথা হয় তার সঙ্গে। কথার ফাঁকে হাতের টর্চলাইট জ্বালিয়ে আশপাশ থেকে কাগজ কুড়াচ্ছেন। কাগজ দিয়ে কী করবেন প্রশ্নের উত্তরে, ‘আগুন জ্বালামো। ঘুরতে ঘুরতে শরীর ঠাণ্ডা হয়া যায়। রাত ৩টার পর আগুন জ্বালায়া গাও সেকিয়্যা (শরীর গরম করে) ফির (আবারও) ঘোরা শুরু করি।’ শীতের রাতে কাজ করতে কষ্ট হয় কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘মাঝে মাঝে শরীর অবশ হয়্যা যায়। কষ্টের শ্যাষ নাই। ভয় বেশি লাগে। সারা রাত বাঁশি বাজাই, বাঁশিটা শক্তি দেয়।’
শীতের তীব্রতা বাড়লে এই শহরে মানুষের আনাগোনা কমে যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে শীতের মধ্যেও রাতভর দায়িত্ব পালন করেন। তাদেরই একজন আবদুল মালেক। বেতন পান সাত হাজার টাকা। পাশাপাশি অঙ্গীভূত আনসারও তিনি। ভোট, পূজাসহ সরকারি ডিউটি পালন করেন।
এই শীতে কিছু মানুষ তার দায়িত্ব পালনে নিবেদিতপ্রাণ। মানুষের শান্তির জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে শীতের রাতে সড়কে সড়কে ঘুরে বেড়ান। পাহারা দেন। এ কাজ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই চলে তার সংসার। রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তারা। যত কষ্টই হোক না কেন তাদের রাত জাগতেই হয়।
নাগেশ্বরী শহরের কলেজ মোড়ে দেখা মেলে নুর হোসেনের। তিনি বলেন, ‘অসুস্থ হওয়ায় গত এক মাস আসিনি। রাতে কষ্টের শেষ নেই। শীতের সময় দেরিতে বাড়ি যেতে হয়। কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না। চুরি হলে তো জরিমানা আমাকেই দিতে হবে। শীতের কাপড়চোপড় না থাকলে অবস্থা খারাপ হয়। খুব কষ্ট হয়।’
সিনেমা হল এলাকায় প্রায় ১০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন আফসার আলী। তিনি বলেন, ‘শতি (শীত) হোক, ঝড় হোক। আমার থাকা লাগে। রাতে সাইকেল নিয়ে ঘুরি। হাত-পা ঠাণ্ডায় জমি যায়। খুব কষ্ট হয়।’
উপজেলা শহর থেকে আশার মোড় এলাকা। মোড়েও ছোট একটি বাজার। সেখানে রাতে পাহারা দেন ৭৫ বছর বয়সী মকবুল হোসেন। আগে ভাঙারির ব্যবসা করতেন। দুই বছর ধরে এখানে ডিউটি করছেন। মকবুল হোসেন বলেন, ‘ঠাণ্ডায় পায়ে বাতের ব্যথা ভাসে। শীত পড়লে হাঁটতে কষ্ট হয়। উপায় নেই। খাওয়া তো লাগবে। কষ্ট করে ডিউটি করা লাগে। মাস শেষে চার-পাঁচ হাজার টাকা পাই। কোনোমতে চলি।’
তাদের মধ্যে রয়েছে গ্রামপুলিশ। ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার শৃঙ্খলা রক্ষায় দিনরাত দায়িত্ব পালন করেন তারা। নাগেশ্বরীর বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ সোলায়মান আলী বলেন, ‘আমাদের শীত-বর্ষা নেই। ডিউটি আছে।’
বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি বলেন, ‘জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য চৌকিদাররা জীবনবাজি রাখেন। শীতেও তারা থাকেন, বর্ষায়ও থাকেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।