
জনবল-সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ফেনীর ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে এসে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালের অবকাঠামো, চিকিৎসক ও জনবল-সংকট, আইসিইউ, সিসিইউ বিকল অবস্থায় পড়ে থাকায় বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া হাসপাতালের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ আর মশা-মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ রোগীরা।
আশপাশের জেলাগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাসেবাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে এই জেলা শহরে আসেন। বিশেষ করে নোয়খালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মানুষ ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু কাগজে-কলমে ২৫০ শয্যার হলেও এখনো ১৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতাল।
ফলে হাসপাতালের গুরুত্ব বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি। জানা গেছে, প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভর্তি থাকেন। এসব রোগীর কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার সকালে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিবিভাগ ও জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। বহির্বিভাগে সহস্রাধিক সেবাপ্রত্যাশীকে সাতজন মেডিকেল অফিসার সেবা দিচ্ছেন। হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারি দেখা গেলেও চিকিৎসকরা তখন ওয়ার্ডে রাউন্ডে ছিলেন। এতে রোগীদের অপেক্ষা আরও বাড়তে থাকে।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরেও ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সেবার মান বাড়েনি। এমনকি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা হয়নি। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চিকিৎসকরা অনিয়মিত, নার্সের সংখ্যাও কম। রয়েছে কর্মচারী-সংকট। দন্ত, চর্ম চিকিৎসাসহ অনেক রোগের পরীক্ষা করানো যায় না। প্রায়ই মেশিন নষ্ট কিংবা অপারেটর নেই শুনে রোগীদের ফিরে যেতে হয়।
সকিনা আক্তার রুনা নামে এক রোগী বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ খুব খারাপ। সবখানে অপরিচ্ছন্ন আর দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ। মশা-মাছির জন্য স্বস্তি পাওয়া যায় না। বসে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ যেখানে সুস্থ হবে, সেখানে এসে বরং উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মর্জিনা আক্তার নামে এক রোগী জানান, জরায়ুর সমস্যা নিয়ে তিনি চার দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্সদের সময়মতো পাওয়া যায় না। যে সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন, সেই সমস্যার সমাধান হয়নি।
মুন্নি নামের এক রোগী জানান, তার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। টাকার অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করাতে পারছেন না। তাই তিনি সদর হাসপাতালে এসেছেন অপারেশন করাতে। কিন্তু তার সিরিয়াল পড়েছে সাত মাস পর। এতদিন দেরি কেন জানতে চাইলে বলেন, চিকিৎসক নেই।
মোস্তফা নামে এক বয়স্ক রোগী বলেন, সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা থাকলেও ফেনী হাসপাতালে কিছুই নেই। ঠিকমতো ডাক্তারদের পাওয়া যায় না। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো যায় না। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে বলে চিকিৎসক নেই। যন্ত্রপাতি নষ্ট। আমাদের কিছু করার নেই।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ৩০৬টি পদের বিপরীতে জনবল আছে ২০৬ জন। ৯ জন সিনিয়র কনসালট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র পাঁচজন। জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১২ জনের জায়গায় আছেন ছয়জন। এক বছরের বেশি সময় ধরে মেডিসিন, শিশুরোগ, রেডিওলজি, প্যাথলজি, সার্জারি, দন্ত, চক্ষু, চর্ম ও যৌন রোগের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। শিশু বিভাগের চিকিৎসক সংকটও প্রকট।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালটি ১৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে। ঘাটতি পূরণের জন্য সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতাল থেকে অ্যাটাচমেন্ট (প্রেষণ) ডাক্তার আনতে হয়। তাদেরও বেশি দিন রাখা যায় না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ে। গত ১০ বছর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় অর্ধশতাধিক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও আট মাস ধরে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। তারা মাঝে মাঝে আন্দোলন করে কাজ বন্ধ রাখেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবকাঠামো, জনবল ও চাহিদামাফিক যন্ত্রপাতি পেলে সেবার মান আরও ভালো করা যাবে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফেনীর ছয় উপজেলার মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। গুরুত্ব বিবেচনা করে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।