
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পরবর্তী সময়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দেশের দক্ষিণের সীমান্তবর্তী এলাকায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারি ও মানব পাচারকারী চক্র। সাতক্ষীরার শ্যামনগর এলাকায় নৌপথ ও সুন্দরবনকে ব্যবহার করে চোরাকারবারি ও পাচারকারী চক্র বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে বলেও জানা গেছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে সীমান্ত এলাকা থেকে মাদকসহ ভারতীয় অবৈধ মালামাল উদ্ধার হয়। এ ছাড়াও পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে পাচার হওয়ার আগে নারী-পুরুষ উদ্ধার করা গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে চক্রের মূল হোতারা। বলা যায়, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী অভিযানের পরও বন্ধ হচ্ছে না মাদক ও মানব পাচার। প্রশাসনকে তুষ্ট করাসহ নানা কৌশলে এসব অপরাধ চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আর এভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের এ অংশটি এখন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে ও গোয়েন্দা সূত্রমতে, উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারি ও মানব পাচারকারী চক্র। এই চক্রের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু ও জেল পলাতক আসামিদের যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ, মাদক ও অবৈধ ভারতীয় মালামাল চোরাকারবারি এবং মানব পাচারের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, কৈখালী, নুরনগর, রমজাননগর, মুন্সীগঞ্জসহ উপকূলের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় পাচারকারীরা অপকর্ম করছে। তারা বিভিন্ন ধরনের মালামাল, মাদক ও ওষুধসামগ্রী অবৈধ পথে ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু-নারী-পুরুষ পাচার করাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারীদের এনে পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সীমান্তসংলগ্ন কয়েকটি অংশকে নিরাপদ রুট (যাত্রা পথ) হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী কালিন্দি ও রায়মঙ্গল নদীপথে চোরাচালানের সুযোগ বেশি এবং ঝুঁকি কম হওয়ায় চোরাচালানের ‘মূল পয়েন্ট’ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে এই এলাকাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চোরাচালানে কাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন শ্রমিক জানান, ভারতীয় চোরাকারবারিরা গরু ও মাদকের চালান কচুখালী, বকচরা, তালপট্টি ও হোগলডুরি এলাকায় রেখে যায়। বড় চালান রায়মঙ্গল এবং ছোট চালান কালিন্দি নদীসংলগ্ন পাঁচ নদীর মোহনা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে যায়। স্থানীয় চোরাচালান চক্রের সদস্যরা মাছ বা কাঁকড়া শিকারের অজুহাতে স্পট থেকে সেই চালান সংগ্রহ করে। সুবিধাজনক সময়ে সেগুলো কৈখালী ও ভেটখালী স্লুইসগেট, আলম চেয়ারম্যান ও আব্দুর রহমানের বাড়ি ছাড়াও গোলাখালী, কালিঞ্চি এবং পশ্চিম কৈখালী বিজিবি ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকা দিয়ে পাচার করে।
এর আগে ভারতের শমসেরনগর, কালীতলা, ঘুমটে ও গোবিন্দকাঠি থেকে মাদকের বস্তা, ওষুধের কার্টন, অবৈধ ভারতীয় মোবাইল এবং বিভিন্ন পণ্যসহ গরু নৌকায় উঠিয়ে দেওয়া হয়।
তারা আরও জানান, কৈখালীর পাঁচ নদীর মোহনা থেকে কিছুটা দূরত্বে বন বিভাগের কৈখালী স্টেশন, রায়নগর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি ও কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প। এই অংশ দিয়ে চোরাচালানে ঝুঁকি রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই তারা চোরাচালানের কাজ করছে। এ কাজ নির্বিঘ্ন করতে তারা তাদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এসব অপকর্ম করছে বলেও জানান। আরও জানা যায়, সুযোগ বুঝে চোরাকারবারির কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা শব্দবিহীন দ্রুতগামী ট্রলারে করে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে সীমান্তের কয়েকটি চোরাকারবারি গ্রুপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় সীমান্তবর্তী নূরনগরের কুলতলী, দুরমুজখালী, কৈখালীর নৈকাটি, পরানপুর। রোহিঙ্গা নারী পাচারের হটস্পট সীমান্তবর্তী সুন্দরবনসংলগ্ন কালিঞ্চির গোলাখালী এলাকা।
এসব এলাকা দিয়ে নৌপথে ভারতে লোক পাচার করা হচ্ছে হরহামেশাই।
আরও জানা গেছে, সম্প্রতি ভারতে রসুন ও সুপারির দাম বাড়ায় বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যাচ্ছে এসব পণ্য। অন্যদিকে ভারত থেকে আসছে মাদক, গরু ও ক্যানসার প্রতিরোধক কেমোর ওষুধসহ ভারতীয় বিভিন্ন অবৈধ পণ্য। এ ছাড়াও অতিসম্প্রতি ভারতীয় আরও এক ধরনের ট্যাবলেট আসছে বাংলাদেশে, যা নেশাজাতীয় ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে রিভারাইন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (আরবিজিবি) কৈখালী ক্যাম্পের একজন কমান্ডার বলেন, ‘এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে বিজিবির কোনো সদস্য জড়িত আছে, এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত কেউ করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রায়নগর নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আমি এখানে একেবারে নতুন এসেছি। মাত্র কয়েক দিন হলো। চোরাকারবারিরা কোন রুট ব্যবহার করছে আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলে আমার সুবিধা হয় অভিযান পরিচালনা করতে।’ তবে খবরের কাগজর অনুসন্ধানে উঠে আসা কয়েকটি রুটের নাম উল্লেখ করা হলে ওইসব স্থানে নৌপুলিশের টহল জোরদার করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মশিউর রহমান জানান, জনবল সংকট থাকায় সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তবে খুব শিগগির বন বিভাগ, নৌপুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযান সুন্দরবনে পরিচালিত হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির মোল্লা বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা নজরদারির জন্য বিজিবি, নৌপুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী কাজ করছে। তা ছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে টহল জোরদার করে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’