
মানিকগঞ্জ জেলার ২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ। শ্রেণিকক্ষের সংকট ও ভবনের অবকাঠামোগত দুরবস্থার কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এদিকে জেলার পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনগুলোর তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
বিদ্যালয়ের ভবনের পিলারে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে, স্তম্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে মরিচা ধরা রড। ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়ছে। কয়েক মাস আগে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও এখনো সেখানে ক্লাস চলছে। শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে বাইরে বসে ক্লাস করতে হচ্ছে। এই চিত্র মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়নের বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
উপজেলার উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্রও একই। শ্রেণিকক্ষসংকটে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরোনো টিনশেড ঘরে কোনো রকমে ক্লাস নিচ্ছেন। তবে ঘরটির অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে শিশুরা প্রতিনিয়ত শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। রয়েছে টয়লেটসংকটও।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলায় মোট ৬৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি উপজেলার ২৬টি বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ। তার মধ্যে ঘিওর উপজেলায় ১৬টি, সিংগাইর উপজেলায় চারটি, হরিরামপুর উপজেলায় দুটি, সাঁটুরিয়া উপজেলায় দুটি, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ।
বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুগ্ধ জানায়, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের ভবনের অবস্থা খুব খারাপ। একতলা ভবনের দুটি রুমে ক্লাস করা যায় না। ছাদ ফেটে গেছে। তাই আমরা বারান্দায় ক্লাস করি।’
একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী রত্না বলে, ‘আমাদের বিদ্যালয় ভাঙাচোরা। পড়াশোনা করতে খুব কষ্ট হয়। আমার আম্মাকে বলছি, আমাকে সুন্দর স্কুলে ভর্তি করতে।’
উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শান্তা জানায়, তাদের বিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা। ভবন ভাঙাচোরা। বৃষ্টির দিন পানি পড়ে, গরমের দিনে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হয়। ক্লাস রুমে ফ্যান থাকলেও সেটি চালানো যায় না। তাছাড়া সব ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীর জন্য মাত্র একটি টয়লেট।
অভিভাবক আখি আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের যে অবস্থা, খুব ভয় হয়, কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে। তাই প্রতিদিন আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসি। শীতকালে কোন রকম পড়াশোনা হলেও গরম আর বৃষ্টির দিনে ওদের অনেক ক্লাস করতে কষ্ট হয়।’
একই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘মেয়ে প্রতিদিন বলে অন্য স্কুলে ভর্তি করতে। কিন্তু দূরে যাওয়া আমার জন্য কষ্টকর। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই পড়াচ্ছি। প্রায় ৩০০ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য মাত্র একটি টয়লেট।’
উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের টিনশেড ভবনটির অবস্থা খুবই নাজুক। দেয়াল ও মেঝে ভেঙে গেছে। এক কথায় এই ভবনটি সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী। শ্রেণিকক্ষসংকটের কারণে বাধ্য হয়ে পুরোনো টিনশেডের ঘরেই শিশুদের কোনোরকমে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। টিনশেড এই ঘরের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ও টিনের চালায় মরিচা পড়ে ফুটো হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় গরম ও বৃষ্টির দিনে। বৃষ্টির দিনে চাল দিয়ে পানি পড়ে। আর গরমের দিনে ফ্যান চালানো সম্ভব হয় না, যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নবনীতা সেন জানান, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। এ জন্য আমরা শিশুদের সুন্দর পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। তাদের পরিপাটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিলে মানসিক যে বিকাশ ঘটে, সেটা এখন আর হচ্ছে না।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেলিনা আখতার খবরের কাগজকে বলেন, ‘জেলায় মোট ৬৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে যেসব বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত, ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা শ্রেণিকক্ষসংকট আছে, তার তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার পর গুরুত্ব অনুসারে বিদ্যালয়গুলোতে আবার ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’