
‘বুড়ো হই (হয়ে) গেছি তো। পাও (পায়ে) চালানোর রিকশায় ওখন (এখন) কেউ উঠতো (উঠতে) চায় না। মানুষ প্যাডেল বাদ দিয়া অটো খোঁজইন (খুঁজেন)‘। এমন মন্তব্য করেন ষাটোর্ধ্ব রিকশা চালক মহরম খাঁ। থাকেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাজিরগাও এলাকায়। শহরে রিকশা চালান সাতচল্লিশ বছর ধরে।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সকাল ৬টা বাজে। যত দূর চোখ যায়, শুধুই কুয়াশা। সড়ক ধরে আলো জ্বালিয়ে ধীরে ছুটছে ছোটবড় গাড়ি। তিন চারটা রিকশাও চলছে। এমন চিত্র দেখা গেলো মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে।
আশপাশে মানুষজনের আনাগোনাও কম। শীতের সকালে মহরম খাঁ যাত্রীদের অপেক্ষায় অলস সময় পার করছেন। কাছে গিয়ে আলাপচারিতায় জানা যায়, ৬২ বছর বয়সী মহরম খাঁর বাড়ি চাঁদপুর জেলার পুরান বাজারে। ১৯৭২ সালে ৯ বছর বয়সে মা বাবার সঙ্গে মৌলভীবাজারে আসেন। অভাবের তাড়নায় ১৫ বছর বয়স থেকেই রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। রিকশা চালিয়েই বড় করেছেন তিন ছেলে ও এক মেয়েকে। দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে, তারা এখন আর খোঁজ নেয় না। তাই বাধ্য হয়েই এই বৃদ্ধ বয়সেও রিকশা চালাতে হচ্ছে তাকে।
তিনি বলেন, ‘যখন কোন প্যাসেঞ্জার (যাত্রী) বলেন ওই রিকশা যাইবাই (যাবে) নি? তখন শুনতে খুব খারাপ লাগে। তবে ওখন (এখন) অনেকেই চাচা কিংবা মুরুব্বিও ডাকেন‘।
আলাপকালে মহরম খাঁ আরও জানান, নিজের রিকশা হওয়ায় তার প্রতিদিনের আয় তিন থেকে চার শ টাকা। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি রিকশা চালান। বয়সের কারণে যাত্রী পরিবহনে কিছুটা কষ্ট হয়। তার ওপর বয়সের ভার এবং প্যাডেল রিকশা দেখে এখন আর রিকশায় যাত্রীরা তেমন উঠতে চান না।
মহরম খাঁ বলেন, ‘জীবনের সাতচল্লিশটা বছর রিকশার সঙ্গে আছি। বহুত (অনেক) ড্রাইভারের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে। তাদের কেউ গ্রামের ভিটেমাটি বেচে, কেউবা পরিবারের ওপর রাগ করে, অনেক শিক্ষিত লোককেও দেখছি (দেখেছি) রিকশা চালাইতে। যখন আয় রোজগারের কোনো পথঘাট কেউ খুঁজে পায় না, তখন ওরা আসে রিকশা চালাইতে। যেমন আমিও আইসি (এসেছি)।‘
তিনি জানান, কাউকেই কখনও দেখেননি শখ করে রিকশা চালাতে।
মহরম খাঁ বলেন, ‘বাবার কোনো জায়গা জমি ছিল না, লেখাপড়াও করিনি। তাই কোনতা (কোনো কিছু) করার উপায় না পাইয়া (পেয়ে) রিকশা চালানো শুরু করি। ওখনো (এখনও) চলছে। হুরু পোয়া (ছোট ছেলে) একটা দোখানো (দোকানে) কাজ করে। সে যা পায়, আর আমি রিকশা চালাইয়া যা আয় করি তা দিয়াই (দিয়েই) চারজনের সংসার চলে। এখন মাইয়ার (মেয়ের) বিয়ে দিতে পারলেই শান্তি।‘
জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে ও নিজেকে সুস্থ রাখতে এ পেশাকে আমরণ আগলে রাখতে চান বলে জানান মহরম খাঁ।
পুলক পুরকায়স্থ/জোবাইদা/