
রাজশাহীর বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র মালোপাড়ায় অবস্থিত ভুবনমোহন পার্কের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভুবনমোহন পার্ককে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। এখনো নগরীতে যে কোনো জাতীয় দিবসে ছুটে আসেন হাজারও মানুষ। বিশেষ করে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্ক কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আসেন তারা। অথচ বর্তমানে এই পার্কটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে। গাড়ি রাখার বিনিময়ে নেওয়া হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া। এ ছাড়া পার্কের ভেতরে বসানো হয়েছে জুতা, স্যান্ডেল ও চায়ের দোকানও।
জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের যুগ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সাল ছিল ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্কটির গৌরবদীপ্ত সময়। ভাষা আন্দোলনের সব পরিকল্পনা গোপনে রাজশাহী কলেজে করা হলেও কলেজ এলাকায় প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তখন ভুবনমোহন পার্ক থেকেই ভাষা আন্দোলনের বার্তা তাৎক্ষণিক শহরবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৪৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের সভাপতিত্বে ভুবনমোহন পার্কে উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক সম্মেলন হয়েছিল। সভায় ভিয়েতনামের সংগ্রামী যুবনেতা মাই থি চাউ অতিথি হিসেবে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়। এরপর ভুবনমোহন পার্কে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পার্কে শহিদ মিনার তৈরি করে মহান একুশে উদযাপন করা হয়। এখানে ৬৪ জন ভাষাসৈনিকের নামফলক রয়েছে। এ ছাড়া একসময় ব্যাপক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও পার্কটির পরিচিতি ছিল।
গত বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চরম অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের নীরব সাক্ষী ভুবনমোহন পার্ক। দীর্ঘদিন ধরে পার্কটির আশপাশে ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসায় সম্পূর্ণরূপে জনগণের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় এবং তার রাজনৈতিক গুরুত্ব আস্তে আস্তে হারাতে থাকে। এবার পার্কের ভেতরেই শহিদ মিনারের সামনে তৈরি করা হয়েছে সাইকেল-মোটরসাইকেলের পার্কিং লট । নানা কাজে আসা মানুষের গাড়ি রাখার বিনিময়ে নেওয়া হচ্ছে ভাড়াও। শুধু তাই নয়, পার্কের প্রবেশদ্বারের মুখ থেকে ভেতরে দুই পাশে বসানো হয়েছে স্যান্ডেলের দোকান। পাশেই একটি চায়ের দোকান এবং ভেতরে বিস্কুট ও বিড়ি-সিগারেটের দোকান। এরপরই সারি সারি রাখা হয়েছে মোটরসাইকেল।
সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা যায়, পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বেশ কয়েকটি দোকান থাকায় পার্কের ভেতরে মানুষের ভিড় লেগেই থাকছে। ফলে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৬৪ জনের নামাঙ্কিত এই স্মৃতিসৌধে জুতা পায়ে উঠছেন কেউ কেউ। শুধু তাই নয়, পার্কিংয়ে গাড়ি রাখার আগে-পরে অনেকেই স্মৃতিসৌধের বেদিতে বসে ধূমপান করছেন।
পার্কে রাখা গাড়ির ভাড়া হিসেবে টাকা তুলছেন মো. রবিন নামে এক যুবক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আরিফুল শেখ বনির ভাই পরিচয় বলে পরিচয় দিয়ে জানান, তারা গত দুই মাস ধরে এখানে পার্কিং লট পরিচালনা করছেন। তখন থেকেই এখানে রাখা প্রতিটি মোটরসাইকেল থেকে ১০ থেকে ২০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে রবিনকে নিজের চাচাতো ভাই বলে নিশ্চিত করে আরিফুল শেখ বনি বলেন, রবিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজশাহী মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা এই পার্কে রাখা মোটরসাইকেল-সাইকেল থেকে ভাড়া আদায় করার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা বলেন, কয়েক মাস আগে কয়েকজন যুবক তার কাছে গিয়ে ভুবনমোহন পার্কে গ্যারেজ করে মোটরসাইকেল পাহারা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কারণ সেখানে রাখা মোটরসাইকেলের হেলমেট ও তেল চুরি হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ভুবনমোহন পার্কে রাখা গাড়ি থেকে ভাড়া আদায়ের বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, স্থানীয় জনগণ তাদের নিরাপত্তা চায় বলে যুবকরা শুধু মোটরসাইকেল পাহারা দেওয়ার জন্য ফি আদায় করছেন।
ঐতিহাসিক পার্কটিকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশে ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখানকার কর্তৃপক্ষ সেগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘ভুবনমোহন পার্কে গাড়ি রেখে ভাড়া আদায়ের ঘটনা আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’