
বরিশালে ৪৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় বৃহত্তর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যশস্য সংরক্ষণাগার (সাইলো) উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রায় ৩৬২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক সাইলোটি নগরীর ৩০ গোডাউন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে। পুষ্টিগুণ অটুট রেখে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত সাইলোতে চাল সংরক্ষণ করা যাবে। খাদ্যসংকট মোকাবিলা ও দক্ষিণাঞ্চলের খাদ্য সংরক্ষণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। চট্টগ্রামের পরে এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর দীর্ঘমেয়াদি আধুনিক খাদ্যশস্য সংরক্ষণাগার হিসেবে পরিচিত হবে। চলতি মাসের ১৩ তারিখ খাদ্য উপদেষ্টাসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাইলোটি পরিদর্শন করেছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, বিভাগের ছয় জেলায় বর্তমানে ৪৬টি এলএসডি গোডাউনের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ টন খাদ্য মজুতের ব্যবস্থা রয়েছে। ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার অত্যাধুনিক খাদ্য মজুত সিস্টেম হিসেবে স্টিল সাইলো হবে বাড়তি শক্তি। খরা, ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের পর ফসল ওঠা পর্যন্ত এই সাইলোর মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
সাইলো নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ‘মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্ট’-এর আওতায় সাইলো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২১ সালে ত্রিশ গোডাউন এলাকায় আমর্ড ব্যাটালিয়ানের দক্ষিণ পাশে ৫২০ শতাংশ জমিতে সাইলো নির্মাণকাজ শুরু হয়। ওই জমির ওপরে থাকা একটি পুকুর ভরাট করা হয়। পুকুর রক্ষায় তখন নগরীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মীরা প্রতিবাদ জানালে সাইলো নির্মাণ প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। পরে ২০২২ সালের জুনে ৩০ গোডাউন অভ্যন্তরের পশ্চিমাংশে সাইলো নির্মাণকাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে নির্মিত আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে জয়েন্ট ভেঞ্চার অব কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড বাংলাদেশ এবং দি জিএসআই গ্রুপ এলএলসি, ইউএসএ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্প প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্টিল রাইস সাইলোতে স্বয়ংক্রিয় তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এতে দুই বছর পর্যন্ত চালের পুষ্টিগুণ অটুট রেখে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। সংরক্ষিত চাল প্যাকেটজাত ও বস্তাবন্দি করতে ঘণ্টায় ৫০০ টন স্পিডের বেল্ট কনভেয়িং এবং চেইন কনভেয়িং ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নদী ও সড়কপথে আসা চাল জেটি থেকে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে অটোমেশনে সংরক্ষণাগারে মজুত করা হবে। অত্যাধুনিক ব্যাগে প্যাকেট করে খাদ্য প্রস্তুতসহ খাদ্যসংকট মোকাবিলায় এই সাইলো ভূমিকা রাখবে।’
কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক তনুশ্রী রঞ্জন দাস বলেন, ‘সাইলোর ১৬টি বিন, বধ্যভূমি-সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে সাইলো পর্যন্ত জেটি, টপ সাইলো স্টিল ব্রিজ, টপ সাইলো স্টিল কলাম, অবকাঠামো ও ট্রাক স্কেল ল্যাব ওয়েট নির্মাণ এবং আধুনিক সব যন্ত্রপাতির স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে পরীক্ষার জন্য সাইলোতে প্রায় দেড় শ টন চাল রাখা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এটি তিন-চার দিনের মধ্যে শেষ হবে। চলতি মাসের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাইলোটি খাদ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবে, আশা করা হচ্ছে।’
আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মামুনুর রসিদ বলেন, ‘বরিশাল অঞ্চলে ব্যাপক ধানের উৎপাদন হয়। তবে এই অঞ্চলে রাইস মিলের অভাব রয়েছে। সাইলো চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল নগরীসহ বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় নতুন রাইস মিল গড়ে উঠবে। এতে কয়েক হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’
তিনি আরও জানান, এই সংরক্ষণাগারে (সাইলো) কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই পুষ্টিমান বজায় রেখে দুই থেকে তিন বছর চাল মজুত করা সম্ভব হবে। বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে প্রতিবছর ধানের উৎপাদন ইতিবাচক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমন, আউশ ও বোরো মিলিয়ে তিন মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। তবে আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এসব ধান উত্তরের জেলাগুলোর দিকে চলে যায়। সেগুলো চাল হয়ে আবার দক্ষিণের জেলাগুলোর দিকে ফিরে আসে। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য চালের দাম বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দক্ষিণ উপকূলে খাদ্য মজুতের বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছর গুদামে বিপুল পরিমাণ চাল পচে যায়। আধুনিক এই খাদ্য সংরক্ষণাগারটি নির্মিত হওয়ায় এসব সমস্যার সমাধান হবে।