
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে খড়িয়া নদী। এক যুগ আগেও নদীটি ছিল খরস্রোতা। দখল-দূষণে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নিজেদের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নদীর পাড় ও চর বিক্রি করছেন। এ যেন নদীর জমি দখলের মহোৎসব চলছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ফুলপুর পৌর শহরে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে গেছে। পৌর শহরের সেতুর দুই পাশে নদী দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক জায়গায় ফসলের আবাদ করা হয়েছে। আশপাশের সব আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। নদীর পানি কচুরিপানায় ঢেকে গেছে। পানি কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছে।
স্থানীয়রা জানান, সিএস রেকর্ডে নদীর জায়গা থাকলেও আরওআর এবং বিআরএস খতিয়ান রেকর্ডে দখল সূত্রে অনেকেই নিজেদের নামে দলিল করে নিয়েছেন। সেই জমি আবার অন্যের কাছে বিক্রিও করা হচ্ছে।
দুলাল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে খড়িয়া নদীর পাড়ে চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া আবদুল খালেক নামের একজন নদীর পাড় ঘেঁষে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যে কেউ দেখলে বলবে সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে। তাদের মতো আরও অনেকে নদীর জায়গা ভোগদখল সূত্রে কাগজপত্র করে বেচাকেনা করছেন। এ নিয়ে প্রশাসনকে বারবার জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
নদীর জায়গায় বাড়ি নির্মাণ করছেন এই অভিযোগ অস্বীকার করে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি আড়াই শতাংশ জমি কিনে বিল্ডিং নির্মাণ করছি।’ একই বক্তব্য নদীর পাড় ঘেঁষে বাসা নির্মাণ করা আবদুল খালেকের। তিনি বলেন, ‘সরকারি লোকজন এসে মাপঝোঁক করুক। আমি নদীর জায়গা দখল করিনি। আমার হাতে দলিলপত্র রয়েছে।’
বিল্লাল হোসেন নামের অপর একজন বলেন, ‘সেতুর নিচে খড়িয়া নদীর অংশটুকু মেন্দুমিয়ার চর নামে পরিচিত। স্থানীয় চৌকিদার কুদ্দুস সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য এ অংশ লিজ নিয়েছেন। পরে তিনি বিআরএস খতিয়ানে নিজের নামে লিখে নেন। এখন প্লট করে বিক্রি করছেন।’ বক্তব্য জানতে চৌকিদার কুদ্দুসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সেতুর পাশে নদীর ওপর কাঠ দিয়ে ঘর বানিয়ে দোকান দিয়েছেন রাজু মিয়া। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা করিনি। কোনো কাজ পাইনি। তাই নদীর ওপর দোকান দিয়ে ব্যবসা করছি। দোকান সরিয়ে দিলে বেকার হয়ে পড়ব।’
পৌর এলাকার বাসিন্দা আবদুল হাই জানান, ১৫ বছর আগেও নদীতে স্রোত ছিল। জেলেরা সারা বছর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে বর্ষাকাল ছাড়া তেমন পানিপ্রবাহ থাকে না। যে যেভাবে পারছেন দখল করে নিচ্ছেন। পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর পানিকে দূষিত করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দখলের কারণে নদীটি এখন সংকীর্ণ হয়েছে।
মাইদুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, মানুষ আগে এই পানিতে নিয়মিত গোসল করত। পানিতে জাল ফেললে ছোট-বড় প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। নদীর দূষিত পানিতে এখন আর কেউ গোসল করে না। জেলেরা কোনো দিন মাছ ধরতে জাল ফেললে সারা দিনের চেষ্টায় যৎসামান্য ছোট মাছ ধরা পড়ে। প্রত্যেকে তার বাড়ির সামনের নদীর অংশ দখল করে আবাদ করছেন। পাশাপাশি জমি অনেকে বিক্রিও করছেন।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলায় ৫৯টি নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে অনেকটির খননকাজ শেষ হয়েছে। কিছু নদীর খননকাজ অব্যাহত রয়েছে। ৩৭ কিলোমিটার খড়িয়া নদী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রাংসা থেকে ফুলপুর উপজেলা অতিক্রম করে হালুয়াঘাটের ভোগাই কংস নদে গিয়ে মিশেছে। নদীটির বেশির ভাগ অংশ ফুলপুরে হওয়ায় এটি ফুলপুর খড়িয়া নদী হিসেবে পরিচিত।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম সীমা বলেন, ‘কাউকে নদী দখল করতে দেওয়া হবে না। নদী সুরক্ষায় আইন রয়েছে। আইন না মেনে কেউ দখল-দূষণে জড়িত থাকলে আইনিব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল বলেন, ‘গত ৫ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় জেলায় ছোট-বড় ২১টি নদী ও খাল খনন করা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তাগাছার আয়মন নদীর খননকাজ অব্যাহত রয়েছে। নান্দাইলের কাঁচামাটিয়া নদীর খননকাজ শিগগিরই শুরু হবে। সবার দাবি বিবেচনা করে ফুলপুরের খড়িয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নদী খননের সময় সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হবে। সেখানে করও জায়গা-জমি থাকলেও আমাদের কিছু করার নেই।’