ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে বছরে প্রায় ৯০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করলেও তৃতীয় টার্মিনালটি চালুর পর যাত্রী ধারণক্ষমতা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে প্রায় দুই লাখ উড়োজাহাজ ওঠানামার চাহিদা সৃষ্টি হবে। তবে এ জন্য দ্বিতীয় স্বাধীন রানওয়ে প্রয়োজন বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু জায়গার সংকুলান না হওয়ায় সেখানে দ্বিতীয় রানওয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এ অবস্থায় ঢাকার অদূরে নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে যাত্রী বাড়ছে বলে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) জরিপে তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে বছরে প্রায় ৯০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করলেও তৃতীয় টার্মিনালটি চালুর পর ধারণক্ষমতা বছরে দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে প্রায় দুই লাখ উড়োজাহাজ ওঠানামার চাহিদা তৈরি হবে। যদিও বিদ্যমান রানওয়ে দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭০ হাজার উড়োজাহাজ ওঠানামা করা সম্ভব। ফলে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে প্রয়োজন হবে বাড়তি ফ্লাইটের। যার জন্য প্রয়োজন আরেকটি স্বাধীন রানওয়ে।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘টার্মিনাল-৩ নির্মাণ করায় যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রানওয়ে। যখন পিক টাইম থাকে, ডমিস্টিক ও ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট ওঠানামা করে, তখন দেখা যায় প্লেনগুলো রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা উড়লে আরেকটা পারছে না। আবার একটা ল্যান্ডিং করলে আরেকটা করতে পারছে না। এর ফলে প্রায় দেখা যায় যাত্রীদের প্লেনের মধ্যে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, প্লেন ঢাকার আকাশে ঢুকে গেছে, কিন্তু ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছে না ল্যান্ডিং করার। আবার রানওয়েতে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে ১-২ ঘণ্টা ওঠানামা বন্ধ থাকছে। এ সমস্যা সমাধানে শাহজালালে নতুন একটি স্বাধীন রানওয়ের খুব দরকার। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা হয়তো আর সম্ভব নয়, কারণ এখন শাহজালালে সেই পরিমাণ জায়গা নেই।’
বেবিচক সূত্র বলছে, বাড়তি ফ্লাইটের চাপ সামাল দিতে আরেকটি বিকল্প রানওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছিল বেবিচক। তবে জায়গার সংকট থাকায় সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। কারণ ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী, পাশাপাশি দুটি রানওয়ের মধ্যে অন্তত ৭৫০ ফুট দূরত্ব থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘দ্বিতীয় স্বাধীন রানওয়ে নির্মাণের সুযোগ নেই শাহজালাল বিমানবন্দরে। কারণ জায়গাস্বল্পতা। এ ছাড়া এটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তার তুলনায় সুবিধা পাওয়া যাবে অনেক কম। জরিপ অনুযায়ী বর্তমান রানওয়েতে ১ কোটি ৭০ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। বাকি থাকছে ৩০ লাখ যাত্রী। এতে যে রাজস্ব আসবে তার থেকে অনেক গুণ বেশি খচর হবে নতুন একটি স্বাধীন রানওয়ে করতে। এ অবস্থায় বিদ্যমান রানওয়ের পূর্ণ ব্যবহার করতে এটিএম ও স্লট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম উন্নত করার দিকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে চালু হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ের মেরামতের কাজ করা হয়, যার আয়ু শেষ হয় ২০০৬ সালে। এরপর দীর্ঘ সময় মেরামতের উদ্যোগ না থাকায় রানওয়ে সারফেসে লম্বালম্বি ও আড়াআড়িভাবে ফাটলের সৃষ্টি হয়। আয়ুষ্কাল পার হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৩ সালে আরেক দফায় রানওয়েটি মেরামত করা হয়। ২০২৬ সালের পরই শেষ হচ্ছে বিদ্যমান রানওয়ের সেই আয়ুষ্কাল। ফলে এর পরই নিরাপদ উড্ডয়নের জন্য বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১০ বছর পর রানওয়ের বড় ধরনের সংস্কার করতে হয়। এ ধরনের সংস্কারে বিদ্যমান রানওয়ের ওপর ২০ সেন্টিমিটার অ্যাসফল্ট কংক্রিট আস্তরণ দেওয়া হয়। রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অ্যাসফল্ট কংক্রিটের আস্তরণ দেওয়া হয়। মেরামতের কাজ শেষ করতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। এ সময় ব্যাহত হয় নিরবচ্ছিন্ন ফ্লাইট কার্যক্রম। এ অবস্থায় বিকল্প রানওয়ে না থাকায় বিদ্যমান এই রানওয়ে দিয়ে কীভাবে যাত্রী সামলাবে শাহজালাল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, প্রায়ই সংস্কারকাজ চলে রানওয়েতে। সংস্কারকাজ চলার সময় ফ্লাইট সূচিও সেভাবে সাজানো হয়। ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংস্কার হলেও ফ্লাইট পরিচালনায় বড় ধরনের সমস্যা হবে না।
এদিকে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান যাত্রীর সংখ্যায় ধারণা করা যায় ২০৩৫ সালের মধ্যে প্যাসেঞ্জার ১৬০ শতাংশ বাড়বে। এটা বিশাল প্রবৃদ্ধি। এই গ্রোথ ধরে রাখতে প্রয়োজন নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এ বিষয়ে কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, এই প্রবৃদ্ধি যদি ধরে রাখতে হয় তাহলে আমাদের ওই ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া দেশের এয়ারলাইনসগুলো বড় হচ্ছে। নতুন নতুন এয়ারক্রাফট আসছে। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে প্রয়োজন নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। হিউম্যান রিসোর্সেস থাকতে হবে, কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। এটা খুব জরুরি ভিত্তিতে দরকার। কারণ একটা বিমানবন্দর গড়ে তুলতে ন্যূনতম ১০-১২ বছর সময় লাগে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে আরও বলেন, ‘এখন সরকার শাহজালালে থার্ড টার্মিনাল কত দ্রুত চালু করা যায় সেদিকে নজর দিচ্ছে। এটা চালু করলে বিমানবন্দরের সক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। তবে এভিয়েশন খাতে এখন বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি, তাতে আগামী ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০৩৫ সালের পর রাজধানীর পাশে আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠবে। এ জন্য নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির বিষয়টি আমাদের চিন্তায় আছে।’