চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনের চারবারের সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য হন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে ভিন্ন তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া গত প্রায় ১৬ বছর তিনি ছিলেন বেশ বেপরোয়া। তার দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল সহযোগী ছিলেন আপন বড় ভাই ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু।
ডা. দীপু মনি গ্রেপ্তারের পর তার ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির নানা তথ্য বের হতে শুরু করে। সংসদ সদস্য হওয়ার পর প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং চতুর্থ মেয়াদে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
মূলত ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিজস্ব বাহিনী গড়েন তিনি। ফলে এলাকার সবকিছু চলে যায় তার নিয়ন্ত্রণে। তার এই কাজে সহযোগিতা করেন হাজি নামে পরিচিত ওসমান গণি পাটওয়ারী, যাকে উপহার হিসেবে দুবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। অবৈধভাবে টাকা আয় করার জন্য তার সঙ্গী হন আওয়ামী লীগ নামধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও চিহ্নিত লোকজন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী বালুখেকো সেলিম চেয়ারম্যান। আর এদের নিয়ে লুটপাটের রাজ্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ছিলেন ভাই টিপু। তিনবার মন্ত্রী থাকার সময়ে তদবির, মনোনয়ন-বাণিজ্য, বদলি, ঘুষ-বাণিজ্য ও বালু উত্তোলনের টাকার ভাগ নেওয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করতেন এই টিপু। এ ছাড়া ছিলেন সাবেক মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান টুটুল, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ব্যাপারী, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম রোমান, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাইদুল ইসলাম বাবু ওরফে বিহারি বাবু। বিহারি বাবুর মাধ্যমে চলত সরকারি উন্নয়ন টাকা লুটপাটের সব কমিশন উত্তোলনের কাজ। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন বদলি-বাণিজ্যসহ শিক্ষকদের হয়রানি করার মূল হোতা ছিলেন পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দীপু মনির অনুসারী এবং লুটপাটে নিয়োজিত সবাই আত্মগোপনে। তার ভাই টিপু দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আর দীপু মনি বর্তমানে কারাগারে। ফলে পতন ঘটে তার ১৬ বছরের সাম্রাজ্যের।
শেখ হাসিনার সঙ্গে একসময় দীপু মনির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় চাঁদপুরের জন্য বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প আনা হলেও নিজেদের লুটপাট ও ভাগ-বাঁটোয়ারায় অমিল হওয়ায় এসব প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন হয়নি। জেলা সদরে তিনি তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে দলকে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত করেন। ফলে বারবার মন্ত্রী হয়েও চরম সমালোচনার মুখে পড়েন দীপু মনি।
বিগত ১৬ বছরে দীপু মনি সাধারণ মানুষকে দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম চাঁদপুর শহর রক্ষাসহ মেঘনা নদীর বাঁধের মেগা প্রকল্প, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অনুমোদন হলেও বাস্তবে অস্তিত্বসংকটে রয়েছে ওই সব প্রকল্প।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সেলিম উল্লাহ সেলিম বলেন, বিগত প্রায় দেড় যুগে দীপু মনি ও তার লোকদের হাতে বিএনপি-জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী গায়েবি মামলার আসামি ও ঘরছাড়া হয়েছেন। তার নিজের দলের লোকজনও রক্ষা পাননি। জুলুম-নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জবাব নিতে অপেক্ষায় আছেন। যদিও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দীপু মনিকে চাঁদপুর আদালতে উপস্থিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
মেঘনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন
সাবেক এই মন্ত্রীর সবচেয়ে বড় টাকার মেশিন ছিল লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিম খান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার হাত ধরেই উত্থান হয় সেলিম খানের। তিনি মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতেন। আর তার ভাগ পেতেন দীপু মনি। তাই তাকে বারবার ডিও লেটার দিয়ে নির্বিচারে পদ্মা-মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুত্রসহ গণপিটুনিতে নিহত হন সেলিম খান।
অভিযোগ রয়েছে, সেলিম খানের এই বালুমহাল থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন দীপু মনি ও তার ভাই টিপু। যদিও এই অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সেলিম চেয়ারম্যানকে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা দিতে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক। অথচ এই অবৈধ বালু উত্তোলনের সমালোচনা করায় ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীও পদ হারান।
এ প্রসঙ্গে ড. মনজুর আহমেদ চাঁদপুর সফরে এসে বলেছিলেন, ‘মেঘনায় অবৈধভাবে যারা বালু তুলছে, তাদের সঙ্গে একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে বলে আমি মন্তব্য করেছিলাম। আর ওই ঘটনার পরই আমি আমার পদ হারাই।’
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ
চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন হওয়ার পর থেকে এর কার্যক্রম চলছে সরকারি জেনারেল হাসপাতালের একটি ভবনে। মেডিকেল কলেজের প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। জমি অধিগ্রহণ থেকে টাকা লুটপাটের বিষয় ধরা পড়ার আশঙ্কায় বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্প। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার শহরতলির নিজগাছতলা এলাকায় হাসপাতালের জমি পরিদর্শন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
নিজগাছতলা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম পাঠান বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন করবেন বলে ওয়াদা করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।’
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ৬০০ কোটি টাকা লুটপাটেরও অভিযোগ ওঠে লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ দীপু মনি চক্রের বিরুদ্ধে। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা জালিয়াতির পাঁয়তারার ঘটনায় তার ভাই টিপুসহ চক্রের সদস্যরা জড়িয়ে পড়েন। এই লুটপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিসের চিঠির পর। এ কারণেই ওই সময়ে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার শহর রক্ষায় স্থায়ী ও শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ভেস্তে যায়। বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয় শহরের খলিশাডুলি এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে অস্থায়ীভাবে চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করা হয় সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা নদীর উপকূলে। এ বিষয়ে ওই এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দা কালু খান, কাজল গাজী ও হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সেলিম চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয় করবে বলে আমাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে। কিন্তু আমাদের সম্পত্তি আজও বুঝিয়ে দেয়নি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপন হয়নি।’
দীপু মনির ভাইয়ের টিপুনগর
দীপু মনির ক্ষমতাবলে তার বড় ভাই টিপু হাইমচর উপজেলার ৪ নম্বর নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে ৪৮ একর সরকারি খাসজমি দখল করে গড়ে তোলেন ‘টিপুনগর’। সেই জমি তিনি নিজ নামে দখলে নিয়ে তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদিপশুর খামার ও সবজির বাগান। যদিও বিষয়টি জানতে পেরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ সরকারি ভূমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে দীপু মনি ওই জেলা প্রশাসককে নেত্রকোনায় বদলি করে দেন।
শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে যত অনিয়ম
২০১৯ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন দীপু মনি। এরপর ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মশিউর রহমানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্য থাকায় তিনি মন্ত্রীর হয়ে নেমে পড়েন তদবির-বাণিজ্যে। আর তার এ কাজে সহযোগিতা করতেন পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। এসব বাণিজ্যের ঘুষের টাকা লেনদেনের রফাদফা করতেন দীপু মনির ভাই টিপু। তিনিই বোনের ক্ষমতাবলে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে ভিসি পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসনের সব পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলি-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষ নিয়োগে ৫০ লাখ ও ভিসি নিয়োগে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতেন টিপু। একাধিক শিক্ষক বলেন, টিপুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করত সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি।
চাঁদপুর শহরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘টিপু ও রতন মজুমদারের মনমতো না হলেই ওই শিক্ষক হয়ে যেতেন বিএনপি-জামায়াত। যেমন আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিকুলামবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় আমাকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল।’
অভিযোগ রয়েছে, দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরেরও নিয়ন্ত্রণ নেন টিপু। তিনি এ দপ্তরের ঠিকাদারদের কমিশন ছাড়া কাজ দিতেন না।
স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ
চাঁদপুরের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করে বলেন, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে দীপু মনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগকে করেছেন কয়েক ভাগে বিভক্ত। এ ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একাংশকে নিয়ে একক রাজত্ব কায়েম করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দলীয় প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই ছিলেন তার চক্ষুশূল। তিনি তাদের ছাড়াই অগ্রহণযোগ্য নবীন নেতা ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি সংগঠন ব্যক্তি কিংবা পরিবারতান্ত্রিক হবে এটা মোটেও কাম্য নয়। ইতোপূর্বে একজনের কারণে জেলা নেতাদের মধ্যে অনৈক্য ছিল। এটা সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে আমি অতীতেও চাইনি, এখনো চাই না। কারণ যেকোনো অনৈক্য সংগঠনকে দুর্বল করে দেয়।’