এশিয়ার স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে জ্বালানি পণ্যটির দাম গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। রাশিয়ার এলএনজি সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে এলএনজির দাম বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার এশিয়াতেও জ্বালানিটির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর রয়টার্সের।
এলএনজি শিল্পের সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থাটির খবরে বলা হয়, উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় আগামী সেপ্টেম্বরে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির গড় মূল্য ১২ ডলার ৯০ সেন্ট বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে এলএনজির দাম গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে এবং এই প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট এলএনজির গড় মূল্য গত সপ্তাহের ১২ ডলার ৮০ সেন্ট থেকেও বেশি।
কমোডিটি প্রাইসিং এজেন্সি আরগাসের এলএনজির মূল্যনির্ধারণী বিভাগের প্রধান স্যামুয়েল গুড বলেছেন, চলতি সপ্তাহে এশিয়ায় এলএনজির দাম বাড়ার পেছনের মূল কারণ হলো, ইউরোপের বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাব। অঞ্চলটির বেশির ভাগ অংশেই উষ্ণ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় এলএনজির চাহিদা কমে গেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় জ্বালানি পণ্যটির দাম কমেছে, যেখানে কিছু পরিকল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে।
রয়টার্স বলছে, আগামী সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং চীনের বেইজিং ও সাংহাইয়ে গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই পূর্বাভাসের ফলে এলএনজির চাহিদা আরও বাড়তে পারে। তবে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বেশির ভাগ যেখানে অবস্থিত, সেই দক্ষিণ-পূর্ব চীনে আগামী সপ্তাহগুলোতে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। এর ফলে গ্রীষ্মের শেষের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার সামান্য সুযোগ রয়েছে বলে জানান স্যামুয়েল গুড।
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক জ্বালানি পরামর্শক সংস্থা ব্রেনচাইল্ড কমোডিটি ইন্টেলিজেন্সের বাজার বিশ্লেষক ক্লাস ডোজেম্যান বলেন, এশিয়ায় গ্যাসের চাহিদা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে, যার ফলে কার্গো শিপিং আরও বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে বর্তমানে এলএনজির যেই দাম রয়েছে, সেই স্তরটি মূল্যসংবেদনশীল ক্রেতাদের স্পট মার্কেট থেকে (পণ্য কেনায়) বিরত রাখতে পারে।
ডোজেম্যান বলেন, সর্বশেষ লা নিনা (স্বাভাবিকের চেয়ে ঠাণ্ডা তাপমাত্রা) আবহাওয়ার পূর্বাভাস দুর্বল হয়েছে, যা আগামী শীতকালে এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায় গ্যাসের চাহিদা কমাতে সহায়তা করতে পারে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় এবং যেখানে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়, সেখানে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেন একটি আকস্মিক আক্রমণ চালানোর পরে চলতি সপ্তাহে গ্যাসের দাম বেড়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবারের শুরুতে ডাচ টিটিএফ হাবের বেঞ্চমার্ক ফ্রন্ট-মান্থ কন্ট্রাক্টের গ্যাসের দাম ৪০ ইউরো ২৫ সেন্টে উঠেছে, যা গত ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। প্রসঙ্গত, টাইটেল ট্রান্সফার ফ্যাসিলিটি বা টিটিএফ হলো নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি ভার্চুয়াল ট্রেডিং পয়েন্ট, যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের কেনাবেচা হয়। এটি গ্যাসুনি ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস (জিটিএস) দ্বারা পরিচালিত হয়। হাব হিসেবে টিটিএফ ইউরোপীয় গ্যাসের বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে গ্যাসের দাম নির্ধারিত হয়, যা ইউরোপের অন্যান্য গ্যাস বাজারকেও প্রভাবিত করে।
আরগাসের স্যামুয়েল গুড বলেন, যদিও এই পয়েন্টের মাধ্যমে সরবরাহে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, তবে হামলার কারণে সুদঝা পয়েন্ট দিয়ে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে এখনো চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। কারণ এই পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস প্রবাহিত হয়। এই হামলার কারণে সেটিতে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তারা। এর ফলে কিছু ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা সীমিত করার জন্য উৎসাহিত হতে পারেন, যাতে করে গ্যাসের দাম বাড়লেও তারা গ্যাস অভাবের সম্মুখীন না হন।
পণ্যের বাজার বিশ্লেষণমূলক প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটস, ৮ আগস্টে সেপ্টেম্বরে সরবরাহের চুক্তিতে কার্গোর জন্য এক্স-শিপভিত্তিতে দৈনিক নর্থ ওয়েস্ট ইউরোপ এলএনজি মার্কারে (এনডব্লিউএম) এমএমবিটিউ বেঞ্চমার্ক মূল্য ১২ ডলার ৬৭ সেন্ট নির্ধারণ করেছে, যা ডাচ টিটিএফ হাবের সেপ্টেম্বর গ্যাসের দামের চেয়ে ১৫ সেন্ট কম। স্পার্ক কমোডিটিজে দাম ১২ ডলার ৭১ সেন্ট এবং আরগাস ১২ ডলার ৭০ সেন্ট নির্ধারণ করেছে। প্রসঙ্গত, নর্থ ওয়েস্ট ইউরোপ এলএনজি মার্কার বলতে আটলান্টিক বেসিনে স্পট ডেলিভারিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের কার্গোর জন্য বেঞ্চমার্ক মূল্য নির্ধারণকে বোঝানো হয়।
স্পার্ক কমোডিটিজের বিশ্লেষক কাসিম আফগান বলেন, আটলান্টিক এলএনজি ফ্রেইট রেট এক মাস পর প্রথমবারের মতো বেড়ে শুক্রবার দৈনিক ৭৫ হাজার ২৫০ ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে প্যাসিফিক রেট টানা সপ্তম সপ্তাহে বেড়ে দৈনিক ৮৬ হাজার ৭৫০ ডলারে পৌঁছেছে।